(৫৫)


(৫৫)
দিন কাল এমন পড়েছে যে কিছু না করেও কাল দিনটা বেড়ে কেটে যায়। কাল দিন বা কালো দিনও বলা যায় যদি নিবিষ্ট মনে প্রচণ্ড ইন্টেন্সিটি নিয়ে গুনতে বসি লাভের ঘরে কতটা। আর যদি এ ভাবে দেখি যে…”ইন্তাই তো হোন্দাই রহেন্দা…” (‘এমন তো কতই হয়’-এর বাংলা… গতবার যখন ব্যবহার করেছিলাম, তখন আমার ব্যবহারিক কারণ জানাতে গিয়ে জান অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল…) তাহলে কিন্তু কাল একদম চিড়িয়াখানা দিন (এত্ত এত্ত ঘটনা এক সঙ্গে চিড়িয়ার মতো কিচির মিচির করছিল যে কি আর বলব।

প্রেসিডেন্সী প্রাক্তনীরা মিলে সিরি ফোর্টে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, ফি বছর সকল সংগঠনই ‘আমরা হ্যাজ’ বলে জানান দিতে করে সেই রকম। তবে প্রেসিডেন্সী তো তাই মের্লবোর্ণের মত বড় স্টেজ ভাড়া করে বসিয়ে দিলে। আমরাও সুর সুর করে গিয়ে বসে রুদ্ধশ্বাস আগ্রহে দেখতে লাগলাম যে চোখ এবং মঞ্চের পর্দা বলে কিসসু নেই মঞ্চ সজ্জা বা শব্দ সজ্জার জন্য আজকাল রিয়েলিটি শোর ঢঙে মঞ্চের অন্দরমহল দেখানোর রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। যেন দর্শকদের ঘাড় ধরে বোঝানো যে ‘হুঁ হুঁ বাপু, এত মেহনতের পরে তালি যদি না দিয়েছ তো হাত দুটির এমন অবস্থা করব যে কালি কালি বলবে…’

সে যা হোক বিখ্যাত শিল্পীরা মাঝে মধ্যেই, বিশেষত প্রবাসী বাঙালীদের ছাগ শিশু মনে করে (এই প্রসঙ্গে আমায় কাকু ডাকব কিনা ভাবা একটি ডেঁপো সহোদরের উক্তি মনে পড়ে গেল যে “আমরা সব পাঁটা আর তুমি চকিত চপলা হরিণী”) তা সেই রকম একটি নাচ টাচের পর এবার ঘোষণা করা হল সিনে প্লে হবে, রবি ঠাকুরের “নষ্ট নীড়”। যা হয় আর কি, এক বিশাল বিখ্যাত বাপের উত্তরসূরী (তা সে যতই বুলস আইতে মারতে গিয়ে তীর লেজের সন্ধিস্থলে লাগুক না কেন) যখন ছবি পুনর্নির্মাণ করতে বসে (রিমেক রিমেক… বাংলায় একটু নাহয় গিমিক-ই দিলাম) তখন সারা বিশ্বের এভারেস্ট, গডউইন অস্টিন, কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথার উপর বসে চুল ছিঁড়ে ফেলে। আর নষ্ট নীড়ের তো দো দো বাপ (সুনীল শেট্টির একটি সিনেমা থেকে ধার করা ডায়লগ) দুজনেই বাংলা সাহিত্য জগতে অলিম্পিয়াস বাসী জিউস ও পসাইডনের মত নাকের ডগায় চশমা নিয়ে নজর রাখছিলেন। তা ডিরেক্টর মহোদয় পুরকি দিয়ে ভড়কি দেবার জন্য হাজির করলেন ৪৭ বছরের পুরনো অমল সৌমিত্র বাবু কে সূত্রধার হিসাবে। তা যে সূতোর গুটলি জট পাকিয়ে ছটপটায় তার তো অনেকগুলি মুখ… একটা ধরে টানলেই পপাত চ মমাত চ… তা তাই হল!

মহীরুহের পতন হবার সময় এদিক কাঠুরেগুলো হাঁক দেয় সামাল হো বলে… শুরুতেই একটি বিশাল অশ্ব ডিম্ব তারপর যথাক্রমে ভাম, শুয়োর ও ছুঁচোর ডিম অবধি ভদ্রতা বশত গিলছিলাম কিন্তু, সুনীল গাভাসকারের ৬০ ওভারে ৩৬-এর শেষ দেখার মত বুকের পাটা ছিল না। তাই কেঁচোর ডিমটি ভূমিষ্ঠ হবার আগেই সযত্নে ফিরে এলাম পার্কিং লটে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব বলে।

কিন্তু এখানে এসেই শুরু হল এডভেঞ্চারের দ্বিতীয় পর্ব। আমার গাড়িটি বিশাল পার্কিঙের একদম শেষ প্রান্তে নিরিবিলিতে বসে জপ করছিল হঠাত কোন মেড়ো বা খোঁট্টা লাল রঙ দেখে জাত ভাই ভেবে গাড়ির গালে গাল ঠেকিয়ে তার লালে লাল মেরে লাল মারুতিটি হ্যান্ড ব্রেক লাগিয়ে রেখে গায়েব। সর্বনাশের মাথায় পা, খোকা হাসে দেখে যা। মিনিট দশেক ধরে মাথার চুল ছেঁড়ার পর (নাটকের নির্দেশক হালদার মশাইয়ের মত) যখন পার্কিং লট অ্যাটেন্ড্যান্ট হাজির হল তখন ভেবেই ফেলেছি প্রায়… হাতির মতো গাড়িটাকে উলটে ফেলে দিয়েই রওয়ানা দেব। (আরেকটি সহজ পন্থা ছিল যে স্টেজে গিয়ে ঘোষণা করিয়ে দেওয়া… কিন্তু, তখন অমলের বিয়ে ঠিক হয়েছে আর চারু কমদামী ইঞ্জিন অয়েল নিয়ে কোঁত পেড়ে পেড়ে ভীষণ ইমো ওলা কথা বার্তা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু আমাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে না। তাই সেদিকে আর রসভঙ্গ করতে গেলাম না… পাতলা ওয়েফার বিস্কুট, হাল্কা চাপেই মাটিতে মিশে যেতে পারে… আর এ তো জাতির সম্মান বলে কথা।)

শেষে পার্কিং লট রক্ষীকে সাক্ষী রেখে জানলা খুলতে যাব হঠাৎ দেখলাম “আইলা, উইমা” একি হেরিনু তব ভুবনে পুলকিত চিত অকিঞ্চিৎ টিত ইয়ে টিয়ে হয়ে গেল…(রবীন্দ্রনাথ নাম্নী আখের সুমিষ্ট রস ফেলে দিয়ে স্বাদহীন ছিবড়ে চিবোতে গিয়ে গলায় চলে গেছে তো তাই আটকে টাটকে গিয়ে বিষম ব্যাপার)। বুদ্ধিমান মারুতি চালক হ্যান্ডব্রেক লাগিয়ে রেখে বিকল্প হিসাবে গাড়ি খুলে রেখে গেছেন। ভাবলাম বোমা টোমাও হতে পারে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে যে বোমা ফাটতে দেখে এসেছি স্টেজে তার থেকে আর কত বড় হবে বলে দরজা ধরে টান দিলাম এবং সত্যি সত্যি খুলে চলে এল।

তারপর আর কি করা তার হ্যান্ডেলের বাঁধন মুক্ত করে সরিয়ে দিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম যেজন আছে মাঝখানেতে… অনেক রকম ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ছিঃ বড় হয়ে গেছি না? ক্রোধানলে শেষে নিজেই জ্বলে রাখ হয়ে যাব ভেবে ভাবলাম থাক। শেষে গাড়ির বনেটের উপর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ভদ্র ভাষায় লিখে এলাম… ভদ্রে, আপন বাহনেরে বহিন সমঝিয়া যত্র তত্র হেলা ফেলা করিয়া না রাখিলে বাধিত হইব।
তারপর আর কি… ফিরে চললাম বাড়ির পথে।

রোককে রোককে!! কি মনে করেছেন গল্প শেষ? সে গুড়ে বালি! সবে তো কলির সন্ধ্যে… আগে রাতটুকু হোক। আমার সহযাত্রীনী আমায় বললেন রাতের খাওয়া তাঁর বাড়িতে খেয়ে যেতে এবং সেই অনুযায়ী পার্শ্ববর্তি দোকানে বেশ চিলি চিকেন টিকেন প্যাঁদাবার জন্য অর্ডার দিয়ে ফিরে গেনু সেথায়… অতঃপর আধ ঘন্টা অপেক্ষা! বাড়ির কর্তা তারপর ফোন করলেন, কি ব্যাপার খাবার কই? উত্তর এলো দু মিনিট… দশ মিনিট পরে আবার… দশ মিনিটে দু মিনিট বেড়ে হল পাঁচ (কে সি নাগ শুনলেই বলে ফেলতেন যে তৈলাক্ত বাঁশের উপর সময় হিসাব করা হচ্ছে… দু কদম আগে তো এক কদম পিছে!!) তা আরও দশ মিনিট পরে কোন সাড়াই পাওয়া গেল না। আসলে শনিবারের বার রাতে জিভের রসনার জন্য জীব ধ্বংস বোধহয় ইষ্ট দেবতার উপর ভীষণ চাপ হয়ে গেছে। একে নষ্ট নীড়ের চাপ তারপর বিনা অনুমতিতে অপরের গাড়ি খোলার পাপ আর শেষ পাতে খাপে খাপ বুদ্ধুর বাপ… বাঁধাকপি চচ্চড়ি খেয়ে মানে মানে ঘরে ফেরো বাপ। নিমন্ত্রণ কর্তা ও কর্ত্রীর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না এতটাই বিব্রত ছিলেন। শেষে আবার আসিব ফিরে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি ফিরলাম…

কিন্তু জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়া জ্ঞান পাপীদের মতো মনের মধ্যে কেউ ঢাকের তালে তালে বলতে লাগল… আসছে বছর আবার হবে… আসছে বছর আবার হবে।

7 thoughts on “(৫৫)

  1. বাহ!! ছোটো ঘটনা দিয়ে রচিত সুন্দর লেখাটি বেশ আমোদ দিল।সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল সাক্ষী বাবদ আদালতে গাড়িটির ছবি খানও দ্যাছ।লেখা বেশ রমনীর মত রম্য।

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান