(৭৭)

যদিও তারাপদ রায় আমার খুব প্রিয় রম্যরচনাকার এবং তাঁর ‘দুই মাতালের গপপো’ আমার প্রথম কেনা তাঁর বই, তবুও এরকম একেবারেই ভাবতে যাবেন না যে পরবর্তী কিছু সময়ে যে বিবরণ আপনারা কিছুটা মুচকি হাসি, কিছুটা হা হা হাসি, কিছুটা হ্যাঁ হ্যাঁ হাসি এবং অধিকাংশটাই ‘ধুত্তেরিকি নিকুচি করেছে… আবার ফিস ফাস?’ সহযোগে পড়বেন তার মধ্যে কোথাও কিন্তু গাপ্পিবাজি নেই।
শুরুটা দেখেই পাঠক পাঠিকারা নিশ্চয় বুঝে নিয়েছেন (এটা ধরতে দোষ কোথায় যে আমার পাঠক/ পাঠিকারা সকলেই বুদ্ধিমান… একদম রাইটার পে গয়া হ্যায়!!) যে এবারের গল্পটি মাতাল বা মাতলামো সম্পর্কিত। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের তুরীয় মার্গের প্রতি আকর্ষণবোধ যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তা অনুধাবন করতে কোন নিউটনের দরকার হয় না। সেই কবে কার অনুরোধে আসরে কবি গেয়ে গেছেন… পিনে কি কসম ডাল দি, পিউঙ্গা কিস তরহা… ইয়ে না সোচা তু নে ইয়ার ম্যায় জিউঙ্গা কিস তরহা…
প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চাটুজ্জের টলটলায়মান বড়লোকের বেহায়া সন্তানকে নিয়ে নিতান্ত অযত্নে লেখা উপন্যাসটি তো বেষ্ট সেলারের নতুন সংজ্ঞা রচনা করেছে। আমাদের নিজেদের অল্পবিস্তর পা হড়কাবার ঘটনাটা এতই সাধারণ যে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সিধে চকের দাগের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অক্ষমতাটাকে ট্যাবুর ভিতরে ঢুকিয়ে বাক্সবন্দি করে ফেলা হয়।
একটা ফালতুকা শের ঝাড়ি এখানে, কবি বলেছেনঃ কোন কমবখত শ্বাস লেনে কে লিয়ে পিতা হ্যায়, দর অসল শরাবই বদনাম হো গয়া হ্যায় অ্যায়সে…
এই প্রসঙ্গে একটা পি জে মনে পড়ল। পুরুষ হিন্দিতে পিতা হ্যায় তো মহিলা কি মাতা হ্যায়? পানি মাতা হ্যায়, দারু মাতা হ্যায়… আহা, শুনলেই কেমন ভক্তির ভাব আসে। (যদিও ওটা পিতি হ্যায় হবে… তবুও ফোকটে খিল্লি করতে আর খরচ কোথায়?)
যাই হোক অনেক সলতে পাকানো হয়েছে। এবার সোজা সুজি আগুন ধরাই। কিছুই না, বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে হুট বলতে দুম করে চলে গেলাম বুঁদি। তা এক অতীব ভ্রমণ পিপাসু (Glutton tourist বলা যেতে পারে) বন্ধুর পরামর্শেই কোটা থেকে আসার পথে ঢুঁ মেরে আসতে চলে গেলাম গাড়ি চালিয়ে। রাস্তা খুব খারাপ কিছু নয় সময়েই পৌঁছে আরএসটিডিসি-র হোটেলে থাকব বলে হাজির হলাম। জেত সায়র লেকের ধারে, ছিম ছাম ব্যবস্থা। অতিরিক্ত বাহুল্য নেই, আবার অসুবিধাও এদিকে নাক সিঁটকোয় না।
তা সারাদিন ধরে ছোট্ট শহরটাকে চষে ফেলে, রাতে লাল মাস (লাল লংকা ফোড়নে মাটির হাঁড়িতে বানানো পাঁঠা) সহযোগে রুটি সাঁটিয়ে কম্বলের আশ্রয়ে চলে গেলাম যাতে সকালে উঠেই বড় প্রিয় এই চচ্চড়ি জিন্দেগিটায় ফিরে আসতে পারি।
সারা দিনের উৎসাহ আর পরিশ্রম মিলে মিশে চোখে মালাইয়ের পরতের মতো নেমে এল ঘুম। এমন ঘুম, যা স্বপ্ন রাজ্যেও জারি করে দেয় ১৪৪ ধারা। কিন্তু বিধির বোধহয় অন্য ইচ্ছা- হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম গেল ভেঙে। কোন রকমে উঠে হাত পা ঠিক কোন কোন জায়গায় তা ঠাহর করতেই কেটে গেলে আধা মিনিট। শব্দকল্পদ্রুমের তো নিরবিচ্ছিন্ন তরজা চলেইছে।
নিজের মধ্যে ফিরে এসে শব্দের উৎস খুঁজে পেতে দেখলাম, আমাদের পাশের রুমটা থেকে (হোটেলের ঘরকে রুম বলে হে ভাগ্নে!)। বেশ বাওয়ালের শব্দ ভেসে আসছে। ছোঁড়াছুঁড়ি চেল্লামেল্লি হই হল্লা সব মিলিয়ে নরক একেবারে জাভেদ আখতার।
একে বিদেশ বিভুঁই, অচেনা জায়গায় কে আবার কখন চেম্বার বার করে কে জানে? তাই কান চেপে ঘুমোতে গিয়েও দেখলাম যে বাক্স প্যাঁটরাগুলোর উপর বড়ই না ইনসাফি হচ্ছে। পদবীর মান রাখতে উঠে গেলাম বুক ফুলিয়ে।
দরজাটা খুলতেই এক ঝলক লেকের হাওয়া বুকের মধ্যে চেপে বসল, আর আমিও নেহাত বলতেই হবে বলে পাশের ঘরে উঁকি দিয়েই আমার চক্ষু তালগাছে উঠে গেল… সারা ঘরে মেট্রো রেলের কাজ চলছে যেন। বাঁদিকের কাঠের সোফাটায় একটা আধবুড়ি মহিলা,(এটা বোধহয় সেই ‘মাতা হ্যায়’) জড়ানো গলায় চিৎকার করে যাচ্ছে, “আরে মীণাজি রোটি খিলা দো…”। মীণার হয়তো সে ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে তখন গিরগিটির মতো শুঁটকো বন্ধুর নাগপাশে বন্দি। সে বন্ধু খেপে গিয়ে এক হাতে মীণা নাম্নী কেয়ারটেকারের গলা চেপে ধরে দ্বিতীয় হাত দিয়ে প্রাণপণে তা টেপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু হায়রে কামবখত নেশা… জোরই আসছে না যুত করে। আর মীণার কথা কি বলি, সে যেমন কর্তব্য পরায়ণ, তেমনই বন্ধুবৎসল। সেও দুলে দুলে বলে যাচ্ছে, “দাবাদে দাবাদে! তু দোস্ত হ্যায় মেরা!”
এদের বয়স এবং চেহারা দেখে যে সব বল পাঁজরার নীচ থেকে এদিক ওদিক গড়িয়ে গেছিল, সে গুলো একটা দুটো ফিরে এলো। তবুও মাতালকে বিশ্বাস নেই। তাই মীণাকে ডেকে গলায় পিনাট বাটার লাগিয়ে বললাম, যা করবে বাবা দরজা বন্ধ করে করো… ঘুমোতে দাও হে বাবা, কাল সকালে কাটবো যে”।
সেও দেখলাম বাধ্য ছেলের মতো দরজা বন্ধ করল, আর আমিও অবশিষ্ট বলগুলি তুলে নিয়ে, বুক ফুলিয়ে ঘরে ঢুকে হাজির হলাম।
কিন্তু আওয়াজ কমেই না… চলেছে তো চলেছেই… পাঁচ, দশ, বিশ… ঘড়ির কাঁটা বিশ মিনিট পেরিয়ে গেলে আর ধৈর্য রাখা গেল না। ও দিকে ততক্ষণে দরজার উপর ধুপধাপ শব্দ। ঘটাং করে উঠে আমাদের দরজা খুলে পাশের দরজায় গিয়ে “গুড়ুম গুড়ুম” করে মারলাম ধাক্কা। আওয়াজ যেন একটু গেল কমে, কিন্তু তারপরেও চলতে থাকল, আমিও আমার সশব্দ উপস্থিতি দিলাম জানান।। মাথায় কিছু একটা বন বন করে আওয়াজ করেই চলেছে। দরজা খুলতেই দেখি বুড়ি আর দোস্ত আমার দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে। মীণার দেখা নাই।
আমি বেশ রাগত স্বরে বলে উঠলাম, “মীণা কাঁহা?” উভয়েই পত্রপাট দরজার পিছনে দেখিয়ে দিল। মীণা বেটা ভয়ে কিংবা লজ্জায় (ঠিক নিশ্চিত নই) দরজার পিছনেই টুকি করছে। যেন বাজ পড়ল, গর্জে উঠলাম, “ইয়ে কেয়া হো রাহা হ্যায়? শোনে নেহি দো গে কেয়া? যাও ঘর যাও?”
মীণা মিন মিন করে বলার চেষ্টা করল, “ম্যায় তো কেয়ারটেকার হুঁ, ইহা হি রহতা হুঁ”।
আমার গলায় তখন বোসের সাউন্ড সিস্টেম ভর করেছে! ডেকে উঠলাম, “ফির বাকিও কো যানে বোলো!” মীণার বন্ধু এক পায়ে খাড়া… বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “চল তুঝে ছোড়কে আয়ুঁ!” মীণাও দেখলাম হাঁ হাঁ করে বেরিয়ে পড়ল, বুড়ি তখনো পুনপুনে পোকার মত বলে যাচ্ছে, “আরে রোটি তো খিলা দে তে…”! কিন্তু জলদমন্দ্র স্বরের সামনে পড়ে তিনজনেই পথের কাঁটা পায়ে দলে সাগর গিরি লঙ্ঘিয়া ছুট লাগালো, যাবার পথে আবার টলটলায়মান জনতার চাপে রিসেপশনের পাখা গেল চালু হয়ে।
আমিও গেলাম পিছন পিছন, গিয়ে দেখি মীণা নিজের বাইকটাকে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে বাইক থেকে ঠিক ছ ইঞ্চি দূরে ক্রমাগত কিক মেরে। রে রে করে উঠলাম, “মরনা হ্যায় কেয়া? যাও পয়দল যাও!” বলে ফিরে এসে সবে কম্বল দিতে যাব মুড়ি, ও মা ঠিক যেন হোটেলের বাইরেই ক্যাঁচ করে ট্রাকের বিশাল ব্রেক মারার শব্দ আর “ঘং ঘং” করে অ্যাক্সিলারেটরের আওয়াজ।
দৌড়ে গিয়ে দেখি ট্রাকটা একটু ঘুরে চলে যাচ্ছে, আর রাস্তায় তিন মূর্তি বাইক নিয়ে উলটে পড়ে। কাছে গিয়ে শুনি বুড়ি চেঁচিয়ে লেক মাত করছে, “আরে মেরা প্যায়ের টুট গয়া রে, কাশী রে ইত্যাদি রে…” আর দুই বন্ধু মিলে রাস্তায় উঠে বসে একে অপরকে বলে বোঝাচ্ছে, “আরে তেরা চড় গয়া! মুঝে চালানে দে!” আর “নেহি ম্যায় তো ঠিক হুঁ, তেরাহি চড় গয়া বোলকে ব্যাল্যান্স ঠিক নহি রাখ পায়া!”
আবার গিয়ে হাঁক পাড়লাম, “মনা করনে কে বাবযুদ ভি বাইক লেকে নিকলা?” মীণাকে ধমক লাগালাম বাইককো প্যায়দল চলাকে লে যাও। আর তার বন্ধুকে বললাম “আরে বুঢঢিকো পৌঁছা দো জলদি!!” সে বন্ধুও আবার বাধ্য ছেলের মতো বলল, “হাঁ হাঁ ঠিক বাত, চল তুঝে ছোড় কে আতা হুঁ!” বলেই বসে থাকা বুড়ির গা থেকে টেনে চাদর নিয়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “আরে চল না ঠণ্ড লাগ রহি হ্যায় মুঝে…” বুড়িও কি বুঝে খচর মচর করে উঠে তার সঙ্গে রওনা দিল।
এদিকে মীণাকে এক গাদা বর্ণপরিচয় পড়িয়ে আমি ফিরে এলাম বাইক আর মীণা সঙ্গে। তারপর বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে তাকে বললাম, “দরওয়াজা বন্ধ করো ঘর কা!” “জী সাব” “পাঙ্খা বন্ধ করো” “জী সাব” “হাঁ আব যাও শো যাও!” “জী সাব” বলে সে তো গেল শুতে।
দরজা খুলে আলতো করে ভিতরে ঢোকার আগে দেখে গেলাম, মীণা খাটের গলার দিকে বসে শোবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কি ভাবে যেন তার মুণ্ডুটা খাটিয়ার মাথার দিকের দেওয়ালে যাচ্ছে আটকে বারবার। আরও কিছুক্ষণ রবার্ট ব্রুসের চেষ্টা সে চালিয়ে যেতে লাগল। আমি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখি পার্শ্ববর্তিনী ফ্যা ফ্যা করে হেসে যাচ্ছেন। তেনার কানে সবই গেছে। পুরোটা বর্ণনা করতেই আখাম্বা খাট কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। আমি কি রকম ঘাবড়ে গিয়ে কম্বলের তলায় পুট করে সেঁধিয়ে গেলাম।
সকালে উঠে বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয়ভাগ পড়াতে যেতেই মীণা পায়ের গোড়ায়। “হুজুর মাইবাপ”!! কি আর বলি! আরেক প্রস্থ কিশলয় টিশলয় পড়িয়ে উঠে ভাবতে বসলাম, “মাইবাপ” তো না হয় হল। মীণা নিজেকে গালাগালি দেয় নি তো “এর বাচ্চা” “তার বাচ্চা” বলে? তবে সকালের আদর আপ্যায়নে আর গায়ে পড়ে দেঁতো হাসি দেখে তো সেটা মনে হল না।
মাতালের গল্পে তারাপদ রায়ের উল্লেখ থাকবে না তা কি করে হয়? একবার তারাপদ রায়ের এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে শুঁড়িখানায় বসে বলেছিল, “তুই আর খাস না, তোর মুখটা কেমন কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে!” তবে সময়টা শীতকাল আর শহরটা উত্তরভারতের কোথাও ছিল কি না তা নিয়ে লেখক নির্বাক। আমেন!

2 thoughts on “(৭৭)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান