(৮৯)


ঠিক কি ভাবে কথাগুলো বলা যায় সেটা আমার জানা নেই, পাঠক পাঠিকারা ক্ষমা করবেন কারণ ফিসফাসের পাতায় আগে হয়তো এই ধরণের কিছু উঠে আসে নি। কিন্তু ফিসফাস তো জীবন থেকে তুলে নেওয়া মণিমুক্তো, তা সেখানে যদি এক ফোঁটা পদ্মপাতার জল লেগে থাকে তো ক্ষতি কি?
বেশ অনেকদিন আগে, সেই সে ছোটবেলায়, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ছয়ই মে রোববার বাবা নিয়ে গেল বি আর সিং হাসপাতালে। তারপর একটা লালচে বাদামী রঙের মুর্গির বাচ্চা আমার হাতে তুলে দিয়ে বাবা আর মা ডিফাইন করে দিল যে এটা আমার ভাই!
ভাল কথা, সে তখন আমি কি না অত ছোটটি নেই! তাই কোলে নিয়ে একটু আদর করতে গিয়ে সেই এক দিনের মুর্গী ছানাটা দিল আঁচড়ে। ধুস মোটে দু কেজি চারশোর মাল, তায় আবার আঁচড়ায় কোন সাহসে রে? তা যা হোক, এত ছোট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নিজেকে বেশ লায়েক মনে হল।
তা সে বাচ্চা আর কতদিন বাচ্চা থাকবে? তবুও বেশ কিছুদিন ছিল বটে- শুরু করল, “নান নান ফুন” আর “গুড নাইট- চিনি নাইট- চা নাইট” দিয়ে। পিতৃদত্ত নাকের দৌলতে আমার ছিল প্যারামাউন্ট ইগো কিন্তু সেটার আবার নাকের উপর দিয়ে গেছে রেলগাড়ি। তার উপর আগেই বলেছি বেশ অনেকটা ছোট। তা হম্বি তম্বি আর দাদাগিরি দিয়ে ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দেওয়া হত যে “সে ছোট আর আমি বড়”!
রা কাড়ত না বিশেষ, দেড় বছর বয়সে যখন ম্যানেঞ্জাইটিস সন্দেহে পিঠে বার তিনেক ইয়াব্বড় বড় ছুঁচ ফুটিয়ে দিল তখনও বিশেষ কাঁদে টাঁদে নি। তার পর শুরু হল বড় হওয়া।
শুরুর দিকে সমস্যা ছিল না, কিন্তু গোলমালটা বাঁধল যখন সে ক্লাস ফাইভে গিয়ে ভর্তি হল লবণহ্রদ বিদ্যাপীঠে। যদিও, আমি তখন নিশ্চিন্তে স্কুলটুলের পাট চুকিয়ে কলেজের শেষ রোপট্রিক অভ্যাস করছি তবুও সেতো আমাদের শত্রু স্কুল। আমার ছিল বিডি আর এটা গেল এডিতে! সাহস তো কম নয়, বাক্যবাণের চাপে চেপ্টে যাবার থেকে ফুলতে শুরু করল ছেলে, “হ্যাঁরে, অঙ্কে কত পেলি?” “ছোঃ, এই দিয়ে তুই আমার ভাই বলে পরিচয় দিবি?” একদিন বাবা আর মা গবেষণা করতে বসে গেল যে দাদা ভাইকে যে সমস্ত বিশেষণে অধ্যুষিত করেছে সেই জন্তুগুলি ভদ্র না অভদ্র? মানে গোদা বাংলায় দাদা গালাগাল দিয়েছে কি না? আমিও কম যাই না শুদ্ধ সংস্কৃতে বদলে নিয়ে তর্ক করে যেতাম।
এ সবের মধ্যেই ছেলেটা বাড়ছিল, তার সঙ্গে বাড়ছিল একটু আধটু পেন ঘষা! অঙ্ক ভালবাসত না সে, কিন্তু সাহিত্য বড়ই প্রিয়। গল্প কবিতার ঝাঁপি আত্মপ্রকাশ করল ১৯৯৫তে- একটা ডাইরীকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে দু বছরের মেহনত!
সেই যে সেই মোটা লোকটা- যেটা মোটা ছিল তার সঙ্গে গুঁতো লাগলো এক মোটা পালোয়ানের তো উড়ল কে? না সেই পাগলাটা যেটা পিছনে পিছনে গান গাইতে গাইতে আসছিল। এই সব আর কি!
তারপর এল ১৪ই মার্চ ১৯৯৬, তেনার প্রথম ইডেন উদ্যানে প্রবেশ আন্তর্জাতিক খেলা দেখার জন্য। তাও যে সে খেলা নয়, বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল। ততদিনে কার্বন কপি! দাদা আজহার তো সেও তাই! তাই সেও ব্রাজিল বেকার আর বেবেতো! কিন্তু বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের সেই মর্মান্তিক ট্রেন থামিয়ে আজহারের আউট আর কাম্বলির কান্না! যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকেই শুরু বোতল ছোঁড়া- জুয়ায় হার অবশ্যম্ভাবী যে! ভারত ৯২-২ থেকে ১০৫-৭! কোন রকমে বেরিয়ে এসেই হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদা! নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই সিটিসির বাসে উঠে বাড়ি প্রবেশ! তারপর?
তারপর আর কি দাদার জীবনটায় ঘটনার ঘনঘটা, একূল ওকূল বেয়ে সে চলে গেল দিল্লীতে! আর ভাই পড়ে রইল কোলকাতায়, নিজেই নিজের পথ করে হেঁটে নেবার জন্য! মাঝে সাঝে বছরে বার দুয়েক গোঁফ দাড়ি সমেত ও হীন অবস্থায় দেখা চেহারাটাকে স্ক্র্যাপবুকে মিলিয়ে দেখা আর তারপর যে যার পথে! অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন!
এখানেই গল্পটা আটকে যেতে পারত! যা হয় আর কি! বড় সড় দাদা হঠাৎ আবিষ্কার করে যে ছোট ভাই আর ছোট নেই আর ছোট নেই! সেই রকম আমিও আবিষ্কার করলাম আরে সে তো বড় হয়ে গোয়ালিয়র পড়তে চলেছে। এতদিন তো শুধু বুড়ি ছুঁইয়ে দায়িত্ব পালন, এখন তো কিছু করতে হয়! তাই সে গোয়ালিয়র পৌঁছবার আগেই দিল্লী থেকে গিয়ে তার থাকার ব্যবস্থা করে টরে বহুদিন পর আবার আমরা রাত কাটালাম স্টেশন রোডের কাছে একটা ধর্মশালায়!
সেখানেই বুঝলাম যে আমি রফি তো সে কিশোর! আমি মাচা তো সে লোটা! বেইমান! বেইমান! করতে পারলি তুই? মোহনবাগানের বংশে কোকিল হয়ে তোর ভাত হজম হয়? ফিরে চলে যাই আবার সেই আজহার, সুমন আর সত্যজিতে! এক ময়ান মে দো তলওয়ার নেহি রহ সকতে পর এক বাগ মে দো ফুল তো রহই সকতে হ্যায়!
সমস্যা অনেক, জানেন? বাড়ির ছোট হবার সমস্যা! আর সে তো আমার থেকেও অনেক ছোট! আমার জমিই আমাকে লড়ে নিতে হয়েছে আর তার তো ছুঁচও জোটে নি! কিন্তু গোকূলে তো একা বলরাম বাড়ে নি!
একবার গোয়ালিয়র গেলাম জারোয়ানি জ্যাকেট দিতে! (বন্ধুরা জঙ্গুলে ভুরুর জন্য ডাকত ‘জারোয়া’! কিন্তু জারোয়া হলে কি আর শীত করবে না? তার উপর আবার গোয়ালিয়রের কালোয়াতি শীত!) গিয়ে দেখি মুখ ভর্তি দাড়ি আর পুরনো একটা কোট পরে একটা ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে, ছাড়িয়ে গেছে ততদিনে আমার মাথা- “ভিক্ষে কচ্ছিলি নাকি? ট্রেন আসতে খেয়াল হল যে দাদা আসছে তাই উঠে এলি?”
– না আমি পরীক্ষা চলার সময় দাড়ি কাটি না!
-স্নানও করিস না নাকি?
পরীক্ষা তো কম্বল হারানোর সময় ধরে চলছে! ওহ ওই গল্পটা জানেন না না? সেই যে সেই এক কিপটে রুমাল হারিয়ে ভেবেছিল যে ৭ দিন দাড়ি না কাটলে রুমালের খরচ উঠে যাবে আর পথে এক সাধুবাবাকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, “বাবাজী, আমার তো রুমাল- আপনার কি কম্বল?” তা কম্বলের মতো জাবদা একখান জারোয়ানি জ্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম! আর সেও এক বছর পর পিছু পিছু এল দিল্লী! চাকরী করবে! অ্যাঁ বলে কি রে? এই সেই দিনের ছোকরা নাকই ছিল না টিপে দুধ বার করার মতো সেটা কবে সেই ছ ফুটি দানব হয়ে গেল আর কবে সেই দানবটা স্যুট বুট পরে দশটা পাঁচটা করতে শুরু করল?
শুরু হল দুই ভাইয়ের সংসার! ভাইপোটাও বড় হচ্ছে! মনন তৈরীর দায়িত্ব নিল কাকু! একই স্বভাব! দুটোকেই বলে বলে পারি না, “ওরে সারা দিন ঘাড় গুঁজে পড়িস না! একটু ওঠ হাত পা চালা!” নরমে গরমে কখনো ভাই হয়ে যায় ভাইপো আর কখনো ভাইপো ভাই! আমারই যত সমস্যা!
কিন্তু দেখলাম জীবন ধারণের নৌকাটা চালাতে চালাতে একে অপরের উপর ভর দিতে শুরু করেছি! ভরসাও! জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়ে যায় ম্যান টু ম্যান পেপ টকে! বাবা মা বলেই খালাস! দু ভাইয়ের মধ্যে একটুও মিল নেই গা?
তা মিল কি ছিল? কিছুতেই না! আমি কাশ্মীর তো সে আন্দামান, আমি চৌমাথার মোড় তো সে ক্লাসিকাল আড্ডা, আমি বৈষ্ণব পদাবলী তো সে ভোরের আযান! তাতে কি? তেলে জলে মিশ খেলেই তো মাছের ঝোল হয় রান্না, ভারত পাকিস্তান পাশাপাশি থাকতে পারে, দুই জার্মানী মিলে যায় আর হয়ে যায় আলি আকবর আর আল্লারাখার সঙ্গত!
কিন্তু বিধি বাম! খবরটা যখন ধরা পড়ে তখনো আমরা চোর পুলিশের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছি!
-এখন না জানিয়ে কোলকাতায় গিয়ে জানা! অনেক কৃচ্ছসাধন করতে হবে! খাওয়া দাওয়া, লড়াই! সব সব!
তাও মুখের হাসিটা মোছে নি! মোছে নি ফিরে আসার ইচ্ছাটাও! ফিরে ফিরে এসেছে বার বার! বুড়ি ছুঁয়েই ব্যাঙ্গালোর আহমেদাবাদ জয়পুর কোচি। পড়া আর ঘোরা- বই লিখব একটা! লেখালেখি তো খেয়ালের বিষয়- শুধু একটি পত্রিকাতেই লেখা একদম বাঁধা, আর কিন্তু বাঁধা পড়ব না কোথাও! কিন্তু নাড়া বাঁধা যে এখানেই, এই দিল্লীতেই! এর মধ্যেই জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে চলে এল তার সীলমোহর, কিন্তু সে চলে গেল ফিরে!
শেষের দিন যেদিন গেল বললাম, “ছেড়ে না দিলেও পারতিস চাকরিটা!” হাসল আমার দিকে তাকিয়ে, সঙ্গত হাসি!
“দিল্লী আসবই! পূজোয় যাব! না হলে জানুয়ারীর ঠাণ্ডাটা কমলে তো নিশ্চয়ই”
অগাস্টেই বলল, “দাদা সবাইকে নিয়ে ফিরে এস! আমি না থাকলে তো তোমাকেই দেখতে হবে!” জন্মদিনেও ফোন এল শেষবার, বলেছিলাম এই তো দশে যাচ্ছি!
বড্ড বড় হয়ে গেছিলি রে! এতটা বাড় বাড়া ঠিক নয়! দ্যাখ এখন! তোর জুতোটা আমার পায়ে হয় না রে! জামাগুলোও এক সাইজ বেশী! কত আর বই পড়ে গান শুনে কাটাব বল? উত্তর আছে তোর কাছে? ধুর ছাতা- বড় দাদা হয়েও যে আমার কাছেও নেই রে! নেইই তো! এখন শুধু নেইটাই আছে!
পাঠক পাঠিকারা, লেখকের আপনাদের প্রতি একটা দায়ভার থেকেই যায়, তার সঙ্গে থাকে ব্যক্তিগত জীবন! দুটো মেশানো উচিত নয়! মেশাই না যদিও! কিন্তু মেশিন তো নই! জমা জল না বেরোলে ভার কমে না! জমে জমে পূতিগন্ধ বেরোয়! তার থেকে ভাগ করে নিই সুগন্ধ। আসলে জীবন ফুরিয়ে গেলেও জীবন্ত সুগন্ধগুলোই থেকে যায় আর যাই আমাদের মত জীবিতরা যারা সেই সুগন্ধ নিয়েই থাকি বেঁচে। তা আপনার কাছে থাকুক না গোলাপ হাসনুহানা জুঁই বেল, আমার বুনোফুলের গন্ধই ছড়াবে আঁধারে আলো!!