(১১৭)

আচ্ছা পপুলার সিনেমার সংজ্ঞা কি? পিপুলের পছন্দ যে সিনেমা। বাঃ বেশ। তাহলে ভাল সিনেমা কাকে বলে? আর খারাপ সিনেমাই বা কি? আরে সে তো আমার পছন্দের উপর নির্ভর করছে- আমার ভাল লাগলে ভাল আর খারাপ লাগলে খারাপ। তবে কি না জনপ্রিয়তাই যে কোন সিনেমার ভাল খারাপ হবার মাপকাঠি হয় না সেটা সকলেই বলে। কিন্তু ভাল খারাপটা যে কে ঠিক করে দেবে এই ব্যাপারে জনগণ নরগণ রাক্ষসগণ সবাই নিশ্চুপ। সকলেই আসলে মনে মনে নিজেকে বেশ বোদ্ধা মনে করি তো। নিজ মুখে আর নিজের গুণগান কি গাইব?

যাই হোক, এ সব তো চলতেই থাকে। আমার পছন্দের বেশ কিছু ফিল্ম বিশেষ চলে নি আবার পারতপক্ষে হলে গিয়ে দেখব না এমন ছবি হই হই করে চলেছে আর চলছেও। সে হাল আমলের এইচএনওয়াই থেকে আরম্ভ করে কেকেএইচএইচ বা ডি৩ থেকে নিয়ে দেবদাস পর্যন্ত সবি সেই ক্যাটাগরিতে পড়ে। অ্যামন কি আমার প্রিয় বলিউডি হিরোও জখম হাম দিল দে চুকে সনম ভুলে গিয়ে অ্যাকশন জ্যাকসন বা হিম্মতওয়ালার মতো ফিল্ম করছে পপুলিজমের চক্করে পড়ে।

তবে তা বলে কি আমি নিজেকে বুদ্ধিজীবী আঁতেল ক্যাটাগরিতে ফেলতে চাইব? কভু নাহি। তাই আমি আমার মতোই মার্কা একটা চালু ডায়লগ দিয়ে এবার ধানাইপানাই বন্ধ করে মেন কোর্সে আসি। সেই ৯৫ সাল থেকে ফিল্মফেয়ার নিয়ে আমার একটা আনফেয়ার অভিমত তৈরী হয়েছিল। অকেলে হাম অকেলে তুমের আমির খান ও রকম মারকাটারি অভিনয় করার পরেও ব্ল্যাক বিউটি জিতে নিয়েছিল শশশশশাহরুখ খানের ডিডিডিডিএলজের চার্মিং ভাবে হামিং করা। পাবলিক খেয়েছিল আর কি। তা সে ছিল কি না ৯৫ সালের গপ্পো। কলেজ তখন চরবরিয়ে চলছে। সন্ধ্যার কলেজে আড্ডা পড়াশুনো আর সকালের কলেজে নন্দন নিউ এম্পায়ারের চর্বিত চর্বণ।

জীবনে তখনো গার্লফ্রেণ্ডও ছিল না যে বগলদাবা করে নে যাবে রোমান্সের ক্লিসের স্যান্ডউইচ চেবাতে। তার আগের বছর বাপ মা ভাই আর বাবার বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে হাম আপকে হ্যায় কউন? দেখতে গিয়ে মাধুরীর বাসন মাজার সময় সলোমনের কুসুম কুসুম ডায়লগ দেখে হলের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “আরে হেল্প কর? খালি পটাবার ধান্দা!” মা বাপ কানে আঙুল চাপা দিয়েছিল আর বাকি দর্শকে আমাকে গাড়ি চাপা দেবার প্ল্যান করেছিল।

সে যাই হোক, ডিডিএলজেকে কেন জানি না কাল্ট সিনেমা হিসাবে শোলের উত্তরসূরি হিসাবে ধরতে কেমন যেন লাগছিল। তাপ্পর এলো টাইটানিক সে তো একেবারে প্রেমে হাবুডুবু জমে বরফ। আমিও তখন প্রেমে ডাব হয়ে গেছি কিন্তু টাইটানিকের সঙ্গে ভাব হলো না। বরং পিএস আই লাভ ইউ টাইপের মিষ্টি আমার পছন্দ হতে লাগলো।

সে আমার কথা থাক ফিরে আসি ডিডিএলজেতে। বললে হবে? ডিডিএলজে এই সপ্তাহে হাজার সপ্তাহে পদার্পণ করল আর মুম্বইয়ের মারাঠা মন্দিরে গত উনিশ বছর ধরে একটা শো এর জন্য রাখা থাকে। তা আমি যতই নস্যাৎ করি না কেন, আম জনতা তো দুধ মুড়িতে মেখে আয়েশ করে খাচ্ছে। তা এই ফিল্মটা কি? সত্যি কথা বলতে কি বলিউডি ক্লিশেগুলোকে নিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে যদি সুস্বাদু বিরিয়ানি রাঁধা যায় যাতে গরম মশলা, ধনে পাতা পেঁয়াজ ভাজা, পুদিনাপাতা, নুন মিষ্টি ঠিক ঠিক জায়গায় পড়েছে তাহলে যা দাঁড়ায় তাই হল দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।

সিমরনের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে, বাউজি লন্ডনে দোকান চালান, রাজ একমাত্রা ছাত্তর হিসাবে গ্র্যাজুয়েশনে ফেল মেরেছে, কিন্তু বাপ দিল দরিয়া। ব্যাস এদের দুজনকে ইউরোপের ট্যুরে পাঠানো আর ট্রেন মিস করানো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা আর তারপরেও সামাজিক মূল্যবোধগুলো নিয়ে উভয়ে কি ভাবে প্লেটোনিক সময় পাশাপাশি কাটালো, কেমন করে যশ চোপড়ার প্রিয় সুজারল্যাণ্ডের রাস্তাগুলোকে আমচি মুম্বাই বানিয়ে ফেলল সেই হল ফিল্মের প্রথম অর্ধ। আর তারপর রাজ কিভাবে সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বাউজির সঙ্গে ‘আও আও’ সহযোগে পায়রা খাওয়াতে গেল, আর গাঁইয়া সমার্ট পাঞ্জাব দা পুত্তরের কিভাবে ব্যাণ্ড বাজিয়ে নিজের বিয়ের ব্যাণ্ড বাজালো আর তারপর সেই অমরিশ পুরীর অমর গলা, “যা সিমরণ যা! জি লে আপনি জিন্দেগি!” আর তাই শুনে রাজ ট্রেনের চেন টানতে গেল ভুলে আর শুধু শুধু দশমণি ল্যাহেঙ্গা পরিহিতা সিমরণকে মারলিন অট্টোর থেকেও জোরে দৌড়িয়ে মারল দর্শকগণের সমবেত হাততালির মধ্যে সেই হল মোটের উপর সিনেমা।

তা এই নিয়েই হাজার সপ্তাহ উনিশ বছর! দম আছে বলতে হবে! কোথায় লাগে এর সামনে নোটবুক, উনিশে এপ্রিল, ভিকি ক্রিশ্চিনা বার্সিলোনা আর এক হাসিনা থি? এরা সব আমার মনের মনি কোঠায় মিথ হয়েই থেকে যাবে আর তারপরেও আমাদের মতন অকালপক্ক আপাত আঁতেলদের শত গালাগাল উপেক্ষা করে ডিডিএলজে, কেথ্রিজি, ব্যাং ব্যাং, চুং চুং টুং টুং ব্যাবসা করে দর্শক মজিয়ে যাবে।

তাই বলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলতে শিখুন। আপনার যা ভাল লাগে তা বিনা হেঁচকি তুলে ভালো বলুন আর খারাপকে মন খুলে খারাপ বলে এগিয়ে চলুন পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে। ‘ভালো হয়েছে কিন্তু আরও ভালো করতে হবে’ এমন ডায়লগ পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টাইমিং-এই ভালো লাগে। আমরা তো ছা পোষা। সে যতই আঁতলামোর ভান করি না কেন।

তা সকালে অফিসে আসবার পথে যখন এফ এম চ্যানেলগুলোতে ডিডিএলজের স্পুফ নিয়ে নষ্ট লজিয়া চলছিল। তখন আমিও একটু উনিশ কুড়ি বছর আগের কলেজ স্কোয়ার, নন্দন, বাগবাজার ঘাট ঘুরে নীলাচলের ফিশফ্রাই, বসন্তের মোগলাই আর সেনাপতির রাজারোলে ভেসে চলে এলাম। আহা আমাদেরও প্রেমকাহিনী থাকে। সে বলিউডি ৭০ এমএম ডলবি সাউণ্ড না হলেও। ভেতো বাঙালী নিয়ে কেউ তো আর মেনস্ট্রিম সিনেমা বানায় না। তাহলে হয়তো ফিসফাস নিয়েও একদিন সিনেমা হয়ে যেত।

যাই হোক, যুগ যুগ ধরে প্রেমকাহিনীর জয়গান চলতে থাকুক। হাজার হাজার রাজ সিমরণ হাতে হাত দিয়ে পপকর্ণ চিবিয়ে মূল্যহীন ক্লিশের মধ্যে নিজেদের স্বপ্নগুলো দেখতে থাকুক এই আশা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার… আহা প্রেম বেঁচে থাকলেই আমরা অমর হয়ে যাব। রহে না রহে হাম ম্যাহেকা করেঙ্গে বনকে কলি বনকে সমা বাগ এ বফা মে…