(৮৩)


(৮৩)
“রাজা সবারে দেন মাল…
সে মাল আপনি ফিরে পাল!!!”

কি সব্বোনাশ! পাঠক পাঠিকারা আবার ধরে বসবেন না যে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখছি! সে ধৃষ্টদ্যুম্নতা আমি করি না বা করার সাহস করি না!! মার খাব নাকি?

তবে কি না অনধিক পাঁচ থেকে সদ্য এগারো কচি কচি থোকা থোকা মেঘেদের ছানারা যদি অপরিচিত ভাষায় সঠিক উশ্চারণে আমার মায়ের ভাষার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনের গানে গলা দেয়। তাহলে ওটুকু চুক ক্ষমা ঘেন্না করে দেওয়াই যায় কি বলেন?

বিশেষত আধো আধো বোলে “কেমন”-এ একটা আড়াই কিলোর বাটখারা চাপিয়ে দিয়ে গুণী কি ভাবে গান গায় তা জিজ্ঞাসা করা বা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে গেলে সেই লাইনটাই স্বরলিপির বাড়া ভাতে ছাই ফেলে বার বার করে গেয়ে যাওয়া।

যে এসব কিছু মূলত করেছে সে তো তৈরী ছেলে… এমনিতে তো তার বাবা আইপড কিনেছে কিন্তু সেট করতে পারছে না বলে তার দুশ্চিন্তার সীমা নেই! “পাপা কো আজকাল টাইম নেহি মিল রহে হ্যায়! বিজি রহতে হ্যায় না!!” তার পরেই খেয়াল হয় জল বয়ে চলে যাচ্ছে- তাই খেই ধরে “পাসান টুটে বেকুল বেগে ধেএ…”!

স্টেজে উঠে সে তো মহানন্দে গেয়ে চলেছে কেমন করে রাজা সবাইকে “মাল” দিচ্ছে আর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে মাইকটাই না চিবিয়ে ফেলে। তা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিলাম মাইকটাকে মাঝখানে করে! তার বোধহয় মনে হয়েছিল জমিদারীতে হাত পড়েছে! ব্যাস আর যায় কোথা! সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রীতিমতো টেরিয়ে গিয়ে মাইকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গাইতে লাগলো “নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি শর্তে”। শেষে তাকে ইঁদুর ছানার মতো সরিয়ে দিতে হল তাও তার মাইক প্রেম যায় না! নেমে এসে বাকি কচিদের অভিযোগ “সারা গানা খারাব কর দিয়ে!”-র মধ্যেও জেগে থাকে তার অবিনশ্বর হাসি- অন্ধকারে চাঁদ আলো করে দেয়!

এসব নিয়েই তো উৎসব- এসব নিয়েই তো স্মরণ! ফুচকায় যদি তেঁতুলের জলের সঙ্গে একটু অন্য কিছু না মিশল বা দুধে এক ফোঁটা চোনা না পড়ল, তাহলে স্বাদ আসে কি করে? আহা! এই নিয়েই তো রবীন ঠাকুর! এদের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন তিনি!

এই ছোট্ট ছোট্ট প্রাণ! সে যতই না আমরা গেলো গেলো রব তুলি, রবীন্দ্র সুরের যে সহজ আবেদন আছে তা ভাষা না জানলেও, ভাসিয়ে নিয়ে যায়- প্রাণের পোকাটাকে নাড়া দিয়ে মৌচাকে রস সঞ্চার করে জন্ম জন্মান্তর ধরে। তার জন্য বিশ্বাসীদের অবিশ্বাস্য তৎপরতার প্রয়োজন নেই। পরম্পরাগতভাবে সে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নৃত্যের তালে তালে জোনাকির মত আলো দিয়ে যায়।

এ সব আশার বাণীর বীণাপাণি রূপে অবতারণার কারণ তো আগের ফিসফাসেই উল্লেখ করেছিলাম। বাক্স প্যাঁটরা সমেত রবীন্দ্র আলোয় আলোকিত হবার জন্য এ ফুল ও ফুল করে বেড়াচ্ছিলাম সারা মে মাস জুড়ে! তার মধুরেণ সমাপয়েৎ হল কাল।

এমনিতে নিজের গান গাইবার চাপ, তার উপর লোক হচ্ছে না বলে আরও জনা দুইকে ধরে নিয়ে এসে এক দিনের অনুশীলনে তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া!(সেই এক দিন কা সুলতান আর কি!) সব মিলিয়ে বেশ ক্যাটাভরাস অবস্থা হয়েছিল দিন দুই ধরে।

তার ওপর এই যদি অবস্থা হয় যে এক দিনকা সুলতান আর সুলতানা তাদের বাড়িতে ফোন করেও গান শোনাচ্ছে যাতে মুখস্থ হয়ে যায় তাহলে সে কি আর ফেল মারতে পারে। তাই বহুদিন পরে মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে উঠেও গলা শুকোয় না আর আর্কলাইটের আলো পড়া মাত্রই গলায় সাগর সেন ভর করে! তার সঙ্গে প্রথম লাইনটাই ভুল করে দুবার করে ফেলতে গিয়েও ম্যানেজ মারা তো তুচ্ছ ব্যাপার। স্টেজের উপর বসেই টুসকি মেরে তাল দিতে দিতে গেয়ে দেওয়া যায় “মধু সমীর দিগঞ্চলে/ আনে পুলকপুজাঞ্জলি/ মম হৃদয়ের পথ তলে… ইত্যাদি এবং প্রভৃতি। মধু তো সর্বত্রই গন্ধে ভরে রেখেছে স্নিগ্ধছায়ায়। সে ছায়ায় পথিক আমরা দু দণ্ড বিশ্রাম না করে যাই কোথায়।

যাই হোক, গানের আগে পড়ে দু চারটে আলোচনা তুলে দিয়ে এবারের মতো আলুনি ফিসফাসটাতে নুন সংযোগ করে কেটে পড়িঃ

১) কেউঃ আচ্ছা, রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যায় নজরুল কই?
কেউ নাঃ তিনি তো সেই ১৯৭৬ সালেই বোধহয় কেটে পড়েছেন…
কেউঃ না না মানে নজরুলের গান?
কেউ নাঃ আরে সে তো প্রচুর লিখেছিলেন… কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো ইন্সটিটিউশনালাইজ করে যান নি যে! তুই এক কাজ কর গান লেখার আগে ইউনিভার্সিটি খুলে তারপর লিখিস!!

২) এরই মধ্যে আয়োজকদের থেকে একজন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের পরিচালিকাকে জিজ্ঞাসা করেছেন সবেঃ এই যে দিদি, আপনারা কি গাইছেন?
আর দিদিও ততোধিক হন্তদন্ত হয়ে উত্তর দিলেনঃ ওহে সুন্দর মরি মরি…!!
ভদ্রলোক বোধহয় ‘ও আচ্ছা’ বলতে দেড় সেকেন্ড সময় নিলেন কিন্তু সেই দেড় সেকেন্ডে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মুখে কতগুলো রামধনু খেলে গেল তার গোদা বাংলায় পোশাকি নাম হল “ব্লাশ করা”! সে যাই হোক ধাতস্থ হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কথাটা ওনাকে বলা হয় নি, রবি ঠাকুর একটা গান লিখে গেছেন ওইভাবে প্রকৃতির উদ্দেশ্যে! নাকি পারেন নি? আমরা যখন স্টেজে উঠতে যাব তখন যে একটা হাজার ওয়াটের অন্ধকারের মধ্যেও হ্যালোজেন মার্কা হাসি দিলেন, সেটা কিন্তু অন্য কথা বলল!

প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ এটা স্ন্যাক্স ফিসফাস ছিল… তা নিশ্বাস নেবার আগেই শেষ হয়ে গেল? কি আর করবেন? রোজ রোজ তো আর বিরিয়ানী রাঁধা যায় না… আজ নাহয় আলুকাবলিই খান!