(১৩০)

আরে গত এপিসোডে একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম। আসলে আমার এই তিতকুটে পারসোনালিটির মূল ভিত্তিই হল আমার তেঁতো প্রীতি। মানে উচ্ছে , করলা, নিমপাতা, পলতা আমার রসনার লাভা স্রোতে লালা বর্ষণ করে, সেই ছোট বেলা থেকেই। কালমেঘ আমার প্রথম বর্ষার মেঘ। নিম বেগুনে মনে আগুন লাগে। পলতার বড়ায় সলতেয় সেঁকে সিক্ত হয় হৃদয়। (আহা কদ্দিন যে পলতার বড়া খাই না! এই পোড়া দিল্লিতে ম্যাপল পাতা এমন কি চিনার পাতাও পাওয়া যায় কিন্তু পলতা পাতার দেখা? নৈব নৈব চ!)

আমার সারা পরিবারকে পইপই করে বলেও বোঝাতে পারি নি যে তেঁতোটা বাদ দিলে করলার মতো স্বাদু সবজি আর নেই। চেষ্টা করে দেখবেন! করলা কাটার পর ঈষদুষ্ণ গরম জলে একটু নুন দিনে করলা ভিজিয়ে রাখলে তেঁতো ভাবটা অনেকটাই চলে যায়। তারপর কোপ্তা কালিয়া রেঁধে দেখুন না ইচ্ছে মতো!

যদিও আমাদের বাড়িতে তেঁতো খাওয়া হয়, কিন্তু তা রসনার বাসনায় নয়। আয়ুর্বেদিক রেসিপি হিসাবে। আমার ছেলেটাও করলা দেখলে এখন নাক সিঁটকোয়। (উদাসী উত্তমকুমারের ইমোটিকন)

কিন্তু ধর্মের কল বোধহয় উলটোবার সময় হয়েছে। আয় দিন আমার মেয়েটি তার গুটগুটে দুই পায়ে হেঁটে এসে খাবার সময় কোলে বসে আমার থালা থেকে মণিমাণিক্য অর্ডার করে। যদিও তাকে বেশ তরিবৎ খাবার দাবারই দেওয়া হয়। কিন্তু তার বোধহয় বিশ্বেস হয় না যে সেগুলোও ভালো হতে পারে। নদীর এপার আর ওপার আর কি! তা সেদিন কাছের পার্ক থেকে কচি কচি বাদামী নিমপাতা বাড়িমুখো হয়েছে। আর ডুমো ডুমো বেগুন কাটা রয়েছে। অফিস থেকে ফিরে এসব দেখে আর সামলাতে না পেরে নিজেই দায়িত্ব সহকারে কম তেলে কুড়কুড়ে করে ভেজে সবে নিয়ে বসেছিলাম। সে মহারাণী এসে সেই খান থেকেই হুকুম করল।

সব বাপ মায়ের সুপ্ত বা ব্যক্ত ইচ্ছা থাকে যে সন্তান যেন নিজের কিছু ভালোলাগাকে আপন করে নেয়। এই নিয়েই মাত্রাছাড়া ঝঞ্ঝাট বা ঝটাপটির শুরুয়াত হয়ে যায়। তা আমার ভালো লাগার নিম বেগুন যদি আর কেউ খেতে চায় তাহলে সত্যিকারের ফ্যানের মতো হাওয়া বিতরণ করেই সুখ অনুভব করতে চাইবই, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তা মহারাণী চাইতেই হুজুর খিদমতগার হাজির করল, একদা সবুজ অধুনা কালচে কড়কড়ে নিমপাতা! মুখে দিতে এক মুহুর্তের জন্য তাঁর মুখভঙ্গিমা পালটে গেল। কিন্তু অপাপবিদ্ধ মন, কালো কে কালো, তেঁতোকে তেঁতো বলতে শেখে নি। সে কুড়মুড়ে অন্য স্বাদের খাবার পেয়েই খুশী। এক গাল হেসে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, “ভাও”! আবার দাও!

আর কি বলব মহায়! পুলকে আমার হৃদয়ের কলমে প্রেমসংগীত লেখা চালু হয়ে গেল। তার মাকে এক গাল হেসে বললাম, “দেখলে? বাপ কা বেটি!” পার্শ্ববর্তিনী তাল ভঙ্গ করলেন খাবার প্রসঙ্গ পাল্টে। কিন্তু তাতে কি? মিশ্র কাফির দরবারি কানাড়া তখনো বুকের মধ্যে তান তুলে রেখেছে। জিয়োহ বেটি।

ছেলেবেলায় আমার বোর্ড গেমের মধ্যে দারুণ লাগত চাইনিজ চেকার খেলতে। তা সেটা কারণ কি না বলতে পারব না। তবে কোলকাতার রাস্তায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া লাল বাস বা সরকারি বাসের ততোধিক বিলুপ্ত প্রায় টিকিট চেকারদের মুখোমুখি কখনই হই নি। তাল কাটল কলেজে উঠে।

এক বন্ধুর মা অসুস্থ, তাঁকে দেখতে যাব বলে বারুইপুরের ট্রেন কখন আছে তা দেখতে কোলাপসিবল পেরিয়ে সবে বোর্ডের কাছে গেছি। আর যাই কোথা? ক্যাঁক করে ধরে সোজা নিয়ে গেল আরপিএফ থানায়। তা যাই হোক, তখনকার দিনের টিউশনির মার্কেটে তিরিশটি কড়কড়ে টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলাম বটে।

আর তারপর দিল্লিতে এসে একবার দুশো টাকা চেকারকে ফাইন দিতে হয়েছিল দু টাকার জন্য। তখনও দিল্লিতে সামান্য দূরত্বের জন্য দু টাকার টিকিট পাওয়া যেত। দিল্লির বাসগুলিতে কন্ডাক্টর আপনার ঘাড়ের কাছে ‘টিকিট টিকিট’ করে টোকা মারে না। তারা বহাল তবিয়তে নিজের সরকারি সিংহাসনে বসে থাকে আর আপনাকেই যাত্রী স্রোতের বিপরীতে গিয়ে টিকিট কেটে ফিরে আসতে হয় ঝাণ্ডা উঁচিয়ে। তা অন্য একটা ঘটনায় রুমাল রেখে টিকিট কাটতে গেছি আর ফিরে এসে দেখি এক জাঠ তনয় রুমালটিকে জানলার উপর রেখে নিজে বেশ আগলে বসেছেন। আমার গা থেকে কোলকাতার জলের গন্ধ তখনও যায় নি। তাই তর্ক জুড়েছিলাম বটে। কিন্তু ষাঁড়ের সামনে লাল শালু নেড়ে বিশেষ ফল হয় না সে ষাঁড় যদি তখন তার প্রিয় বিচুলির সন্ধান পেয়ে যায়।

তা যাই হোক আগের গল্পটায় ফিরে আসি, আর কে পুরম থেকে বসন্ত বিহার চারটি স্টপেজ। তার মধ্যে একটি অতিবাহিত, তা আমি ঝটপট দুটি টাকা বার করে কন্ডাকটরকে দিতে যাব আর ও মা সে জানলা দিয়ে মুখ বার করে কি যেন দেখে হাত সরিয়ে নিল। আর মুর্তিমান অমঙ্গলের মতো খান চারেক ধূসর পোশাক পরিহিত চেকার উঠেই ক্যাঁক করে আমায় ধরল। তাদের যত বলি যে আমি টিকিট কাটতে যাচ্ছিলাম, কিছুতেই বিশ্বাস করে না। তবে বিশ্বাস না করার কারণ বোধহয় কোটা সম্পূর্ণ করা। মানে তাদের সারা দিন ধরে তমুক সংখ্যক লঙ্ঘনকারীকে ধরা এবং অমুক সংখ্যক অর্থ জরিমানা হিসাবে সংগ্রহ করার হুকুম থাকে বোধহয়। সেই প্যাঁচে দুটাকার বদলে দুশো টাকা দিয়ে পাসপোর্ট উদ্ধার হল।

তবে এবার যে গল্পটি বলব (বা সত্য ঘটনাটি বলব), সেটি কলেবরে এই সকল গল্পের মধ্যে ভীম ভবানী। এটি আমার সঙ্গে হয় নি, জয়পুরের সেই ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুর সঙ্গে ঘটেছিল।

কলেজে পড়ার সময় কোন কারণে সে ও তার বন্ধু দুজনে কোলকাতা এসেছিল। সে বর্ধমানের আর তার বন্ধুটি দুর্গাপুরবাসী। তা একইভাবে টিকিট না কেটে ট্রেন কখন আছে দেখার জন্য তারা হাওড়া মেন স্টেশনে ঢুকে পড়েছিল। আর ঠিক একইভাবে তাদেরকেও পরীক্ষকরা ক্যঁক করে ধরে। তা দুজনেই নাকি একটু শান্তশিষ্ট ভিতু প্রকৃতির ছিল। আর তাদের ভয়ার্ত চেহারায় আরও দু তিনটি বলিরেখা যুক্ত হল যখন তারা আরপিএফ থানার ভিতরে বসে থেকে পাশের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিল ‘বাবা রে, মা রে মেরে ফেলল রে’ চিৎকার। তাদের সন্দেহ নিরসনের দায়িত্ব সেই চেকারই নিলেন। তিনি বললেন, “ও কিছু না পকেটমার ধরা পড়েছে তো!” তা পকেটমারের পকেটে কে আর দেখতে গেছে কোন পরিচয়পত্র আছে কি না পকেটমার বলে। তাই বন্ধুটি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, যে দেখুন আমার কাছে একশো টাকা আছে। বাড়ি পৌঁছত হবে তো! তাই পঞ্চাশ দিই?

কিন্তু তার বন্ধুটার হঠাৎ কি হয় কে জানে? সে ছুট লাগালো সেখান থেকে, কিন্তু উসেইন বোলট না হোক সে নিদেন পক্ষে আদিল সুমারিওয়ালাও ছিল না। তাই চড় চাপড়ের মাঝে উভয়ে মিলে একশো টাকা দিয়ে তবে রফা হয়। তারপর হুড়মুড়িয়ে দেখে শুনে একটি ট্রেনে তারা উঠে পড়ে। নির্দিষ্ট সময় বন্ধুটি বর্ধমান আসায় নেমে পড়ে আর তার বন্ধুকে বলে তুই দুর্গাপুর পৌঁছে খবর দিস। কিন্তু ততক্ষণে নটা বেজে যাওয়ায় আর একে সারাদিনের ধকলে আমার বন্ধুটি অচিরেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে টেলিফোনের চিল চিৎকারে ঘুম ভাঙে। সেই বন্ধুটি নাকি সারা রাত ঝড় ঝাপটা সামলে বাড়ি পৌঁছে কোনরকমে রাত কাটিয়েই বেইমান বন্ধুর উপর হামলে পড়ে ফোন করে।

কিছুই না, আমার বন্ধুটি নেমে যাবার পর তার বন্ধুটি ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে দুর্গাপুরে তো ট্রেন আপসেই থেমে যাবে। কিন্তু যখন তার ঘুম ভাঙে ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, আর ট্রেনটা নাকি দুর্গাপুর যায় নি এবং শান্তিনিকেতনের পথে চলছিল। ছেলেটি কিছু না বুঝতে পেরে ক্রমশ ফরসা হয়ে আসা সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে তারা ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছে। তারপর কোন রকমে পরের স্টেশনে নামে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ অপর একটি লোকাল ট্রেন ধরে সে ফিরে আসে বর্ধমানে। দুর্গাপুর যাবার ট্রেন তখন পাশের প্ল্যাটফর্মে আসব আসব করছে। সে লাইন পেরিয়ে সেই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সামনে সাদা শার্ট পরিহিত এক ভদ্রলোককে বলে “দাদা হাতটা ধরুন!” ভদ্রলোক তাকে প্ল্যাটফর্মে তুলে নিজের কালো কোটটি পরে বলে, ‘টিকিট?’ আর যা হবার তাই হয়! সে রাতে কে আর গল্প শোনে। শেষে কপর্দক শূন্য অবস্থায় দুর্গাপুর এসে রাতের অন্ধকারে লাইটহাউসের মতো জেগে থাকা একমাত্র পরিচিত এসটিডি বুথ থেকে সে কাঁদোকাঁদো অবস্থায় বাড়ি ফোন করে বাবাকে অনুরোধ করে গাড়ি পাঠাতে! বাবা গাড়ির ব্যবস্থা করে তাকে বাড়ি নিয়ে যখন পৌঁছন ততক্ষণে স্টুডিওর ঘড়িতে ছোট কাঁটাটি দুইয়ের ঘরে ঘোরাফেরা করছে।

পাঠক/পাঠিকারা যত পারেন হাসুন, কিন্তু সেই বেদনাহত ছেলেটির সঙ্গে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমনই কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা মনে করে একটু দীর্ঘশ্বাস অন্ততঃ ফেলবেন। ছেলেটি অজান্তেই একটু শান্তি পাবে! আমেন!
being-gratuitous
প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ বর্তমান ভারতীয় একদিনের ও টি২০ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক শ্রী মহেন্দ্র সিং ধোনি একদা দক্ষিণ পূর্ব রেলের টিকিট কালেক্টর ছিলেন। তবে সে অন্য কোন জীবনের গল্প বটে।