(১৮২)

আমার মামারবাড়ি ছিল তেলিপাড়ায়। ছিল বলছি কারণ বর্তমানে সেখানে কেউ থাকে না। বড়মামা সল্টলেকে থাকেন। তবে তিনি দেশে ফেরার পর থেকে তাঁর সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তার আগে?তার আগে বলতে পারব না, কিন্তু ফিসফাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে মামাদের সঙ্গে আমার একটা বেশ অম্লমধুর সম্পর্ক আছে।
ও হো, এ মামা সে মামা নয়। এ হল ইউনিভার্সাল মামা, চোস্ত ইংরাজিতে যাকে বলে সর্বজনীন মামা।
মামার গল্প ফিসফাস ভর্তি, তবে একটা করার লোভ সামলাতে পারছি না। কনট প্লেসের আউটার সার্কেল আর ইনার সার্কেলের মাঝে একটা সিনেমা হল আছে ওডিওন। পুরনো, সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা। তা তার সামনে একটা পার্কিং রয়েছে।
তখন স্কুটার চালাতাম, দিল্লির কনট প্লেসে যাঁরা এসেছেন তাঁরা জানেন যে কনট প্লেসের ইনার, মিডল আর আউটার সার্কেল ওয়ান ওয়ে। অবশ্য ইনার আর আউটার ক্লক ওয়াইজ আর মিডল অ্যান্টি। তা বাইরে দিয়ে এসে মিন্টো রোডের সামনে যে কাটটা ভিতরে গেছে সেখানেই সেই পার্কিং, আউটার সার্কেল থেকে মাত্র দশ কদম। কিন্তু এখানে পার্ক করতে গেলে আপনাকে পুরো চক্কর লাগিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার ঘুরে এসে করতে হবে।
তা দিনটা ছিল ১৯শে নভেম্বর। সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। অবশ্য দিল্লির জাঠ পুলিশ সলিল চৌধুরীকে কি চিনবে? তার থেকে ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন বলেই চালাই। তা সেদিনই হঠাৎ মাথার ক্যাড়া নড়ে উঠল এবং আমি আউটার সার্কল দিয়ে ঘুরে পুক করে রঙ সাইডে ঘুরিয়ে পার্ক করে সিনেমা দেখতে ঢুকব ঠিক করেছি।
সে এক দিনকাল ছিল বটে, তখন বুক ফুলিয়ে টয়স্টোরি দেখতে ঢুকলেও কেউ ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকত না। তা শাহজাদা সঙ্গে ছিল, আর দশ কদম, সিনেমাও শুরু হব হব করছে, তো দিয়েছি ঘুরিয়ে। আর ঘুরিয়েই দেখি, মামা একটা স্কুটারের উপর গাধার উল্টোপিঠে, (গাধার আবার সোজা পিঠ হয় নাকি? কে জানে!) বসে লাঠি দোলাচ্ছেন। সেই যে সেই লোকটা একটা খালি বাথটাবে ছিপ দিয়ে বসে ছিল আর যেই কেউ ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘কি দাদা, কটা মাছ ধরলেন?’ তার উত্তরে বলছিল, ‘যাহ, খালি বাথটাবে মাছ থাকে নাকি! এ তো আপনার মতো বোকা ধরছি, আপনাকে নিয়ে খান সাতেক হল!’
তা মামাও লাঠি দোলাতে দোলাতে শর্টকাট পাবলিকদের ধরছে।
আমাকে ঘুরতে দেখেই ক্যাঁক করে আটকাতেই আমি হাঁউমাউ করে বলে উঠলাম, ‘ইয়ার আজ মত পাকড়ো!’সেও রসিক! জিজ্ঞাসা করে, ‘কিঁউ? আজ আপকা জনমদিন হ্যায় কেয়া?’
পাঠক/ পাঠিকা মনে করুন দিনটা ১৯শে নভেম্বর। আর ১৯শে নভেম্বর এসব সওয়াল কেউ করে! ফক করে প্যান কার্ড বার করে, (তখন আধার ফাদার দিনের আলো দেখেনি) ফিক করে হেসে বললাম, ‘একদম! ইয়ে দেখিয়ে!’
সে মামা দিলের ছিল, জাঠ হলেও সেন্স অব হিউমার, সর্ষের ক্ষেতে ফেলে আসেনি। তাই সেও ফুক করে হেসে বলল, ‘আচ্ছা যাইয়ে, হ্যাপ্পি বাড্ডে!’

তারপর এদিক ওদিক বেশ কিছুবার আলফালভাবে পুলিশ ধরেছে। একবার তো রবিবার দুপুরে ফ্লাইওভারের থেকে নামার সময় স্পিড ৬১ কিমি উঠে যাওয়ায় লাইসেন্স নিয়ে তিন মাস রেখে দিয়েছিল। তারপর লাইসেন্সের চচ্চড়ি করে ফেরত দিয়েছিল। তাও ২০ কিমি দূরে আরটিও থেকে এক দিনে বার দুই গিয়ে এনওসি নিয়ে এসে তবে।
তা তবে থেকে সেই চচ্চড়ি লাইসেন্সই প্যাকেটে ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে মোবাইলে গোটা লাইসেন্সের ছবি।
আর ইদানিং যে হেতু ক্যামেরায় ক্যাচ কট কট করছে তাই একদম নিয়ম ভাঙি না।

কিন্তু বিধি বাম হলে বিধানসভায় শূন্য হওয়া আটকায় কে!কাল একটা ইউটার্ন নিতে গিয়ে সামনের গাড়িটা ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলিয়ে দিল আর আমি ইউটার্ন না করে রাইট টার্ন নিতেই দেখি মামা দাঁড়িয়ে। একজন নয়, পুরো রাঙা মামা, ন’মামা আর সেজো মামা! কিসসু করনের নাই! দু হাত তুলে সারেন্ডার করলে স্টিয়ারিং কে ধরবে! তাই এক হাত তুলেই করলাম। রাঙা এসে সেজোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। সেজো বললে, ‘লাইছেন!’

আমি লাইসেন্সের ছবিটা আর চচ্চড়ি বার করলাম। বেশ কিছুদিন সে পার্সে থেকে আরও মজেছে আর স্বাদ যা হয়েছে না! তা সেজো দেখলাম ভালো। তাকে বললাম, ‘মামু সব দোষ আমার। মুহূর্তের সিদ্ধান্তহীনতা! আর কী করব! কপাল! ইত্যাদি এবং প্রভৃতি!’

তা সে আস্তে করে বলল, ‘স্যার নয়া বানওয়া লিজিয়ে। ওয়সে, রেড লাইট জাম্প করনে সে ৩ মাহিনে লাইসেন্স জব্দ হোতা হ্যায়! পর আপকা লাইসেন্স নিকালনে মে তো পাগলায় যায়েঙ্গে!’

এ সব ক্ষেত্রে না, ঠিক ‘পুশ ইন দ্য বুট’এর বেড়ালটার মতো জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিসসু বলতে নেই। আর আমি স্যার মামা দেখলেই গলে যাই!

আমার পনেরো দিনের না কামানো দাড়ি দেখে বোধহয় মায়া হল, বলল,’যাইয়ে!’

বাড়িতে গিয়ে পার্শ্ববর্তিনীকে বলতেই এমন মুখ করলেন যে কোদাল দিয়ে চেঁচে সাফ করে দিতে হল। আর সে যাক, গোটা লাইসেন্স না রাখার একটা সুফল অন্ততঃ পেলাম, কী বলেন! তবে আপনারা আবার লাইসেন্স দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধতে যাবেন না! কে বলতে পারে, ফোড়ন এদিক ওদিক হয়ে গেলে ক্যাটাভরাস কাণ্ড ঘটবে না!

(১৭৬)

এই ফিসফাস পড়ার আগে কিন্তু কথা দিতে হবে যে হিন্দিভাষী দিল্লিবাসী কোন বন্ধুকে নাম উল্লেখ করে গল্প করা যাবে না। আসলে কারুর ক্ষতি হোক এমন চাওয়াটা ফিসফাস লেখকের স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু বলতেই পারেন, তাহলে এসব গল্পের প্রয়োজন কী! তা বলতে কিন্তু এমন রসালো ব্যাপার স্যাপার যে শেয়ার না করেও পারছি না। আসলে কাল পর্যন্ত ডাল ফ্রাই ছিল। কিন্তু কাল ঠিকঠাক তড়কা পড়ায় একদম স্লার্প মার্কা ডাল মাখনি হয়ে গেছে।
হেঁয়ালি না করে পেড়ে ফেলি ক্ষণ। আসলে ফিসফাস লেখাটা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখেছি আমার সঙ্গে ঘটা ঘটনার সংখ্যা প্রভূত পরিমাণে বেড়ে গেছে। অবশ্য না হলে এক দুই পেরিয়ে তিন নম্বর বইয়ের যোগান দিতাম কী ভাবে!
তবে অফিসের চৌহদ্দিকে আমি এতকাল ফিসফাসের কানাকানির বাইরেই রাখতাম। হাজার হোক কার্যনির্বাহী দায়িত্ব বলে একটা কথা আছে। তবে সেখানেও কম ঘটনা ঘটছিল না।
এই তো মাস চারেক আগে অফিসের এক ছিটগ্রস্ত মহিলা আমায় ইয়ে নিবেদন করে বসে। এসব ক্ষেত্রে আমার প্রত্যুত্তর হয় রাহুল দ্রাবিড়ের মতো। মানে স্টেনের বাউন্সার বা ওয়ার্নের লেগব্রেক, সবেতেই ইগনোরের ডেড ব্যাট।
আমার দিল্লি জন্মের গোড়ার দিকে অফিসে এরকম এক দীর্ঘাঙ্গীর মনোযোগের স্বীকার হয়েছিলাম। অবশ্য তখন বুঝি নি সেইই। যদিও বুঝে ঘন্টা হতো। আমি তদ্দিনে লটকে পড়েইছি। তাতে কি! বুড়ো বয়সে নাতিনাতনীদের কাছে নিজের দর বাড়াতে এসব গল্প কথা কাজে লাগে। তা সেই দীর্ঘাঙ্গী হিসেব করে আমি যখনই অফিসের টেলিফোনের কাছের কম্পিউটারে বসেছি (সে যুগের এমএস ডস কমপ্যাক কম্পু) তখনই ফোন করে আড্ডা মারতে চাইত আর আমি বেমক্কা ফোন রেখে দিতাম। শেষে একদিন সে বলেই ফেলল, ‘ফোন মাত কাটিয়েগা! আপ বাত কিঁউ নহি করতে হো?’ ল্যাহ! এর জবাব সত্যিই ছিল না। তাই তখনই কেটে দিই এবং খোশগল্পের সেখানেই ইতি। ছ মাস পরে জানলাম ইনিই তিনি! তা ততক্ষণে তো লোহার টোপর পরাও হয়ে গেছে। তাই সে গল্পের সেখানেই কাঁচি হয়ে গেল।

মাঝে এদিক ওদিকে অফিসে খুব একটা সমস্যা সৃষ্টি করি নি, কিন্তু গত বছর ক’মাস ধরে পাঞ্জাবী পরাই আমার কাল হল। সে যাই হোক এখানেও ডেড ডিফেন্স। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হল। সে মহিলা মনে করলেন ‘মৌনং সম্মতিং রামচন্দ্রং’। তা সব কিছু ছেড়ে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে শুরু করলেন। অবশ্য সেটা আমি দেখি নি কারণ তাঁর সমস্ত বাক্যালাপই যাচ্ছিল মেসেজ রিকোয়েস্টে। কোন এক কারণে মাস দুয়েক পরে মেসেজ রিকোয়েস্ট খুলে তো চক্ষু সুপারিগাছে। আইল্যা এ যে পুরো অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ফেঁদে বসেছে। মোবাইল থেকে ব্লক করতে গিয়ে দিলাম ডিলিট করে। আরও কেলো। আমার কাছে কোন প্রমাণ রইল না। পরের দিন ল্যাপটপ খুলে প্রথমেই ব্লক করলাম। ভাবলাম ঘাড় থেকে নামল। ওম্মা! একদিন পরে, সেক্রেটারির চেম্বার থেকে বেরিয়েছি, আমায় তিনি করিডোরে পাকড়াও করে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কাল জো মেরে হাসব্যাণ্ড কো আপনে মেসেজ ভেজা, ও দুবারা করেঙ্গে তো, ম্যায় …… (পার্শবর্তিনীর নাম করে) কো বতা দুঙ্গি!’
লাও গোবিন্দ এবার ডুগডুগি বাজাও। কোতোয়ালকে ধরে চোর নিজেই দাবড়ায় দেখি! করিডোরে নাটক না করে নিজের রুমে এসে দরজা খুলে স্টপার লাগিয়ে মহিলাকে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ আপ জানতে হো আপ কেয়া বোল রহি হো?’ সে তো তখন হিমালয় লঙ্ঘনের মুডে। আমায় বলে, ‘আপনে জো শুনা ওহি আপকো বতা রহি হুঁ!’ নাহ এর সঙ্গে তর্ক বৃথা। সটাং বিতারণ করে। সামনের হলের দু তিনজন মহিলা কর্মীকে ডেকে নিলাম। সৌভাগ্য যে তাঁরা প্রত্যেকেই এ মহিলার ছিটলেমি সম্পর্কে অবহিত। অতএব, তারা আমার পাশেই দাঁড়াল। কিন্তু যেটা জানলাম সেটা আরও সমস্যাব্যঞ্জক। এ মহিলা নাকি আগের ডিপার্টমেন্টে নিজের বসের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনে খুব নাঝেহাল করেছেন।
মেরেছে। কোন ঝুঁকি না নিয়ে ডিপার্টমেন্টের যৌন উৎপীড়ন কমিটিতে রিপোর্ট করতে মনস্থ করলাম। ছাতা আমার ডেস্কটপটাও সেদিন বেগড়বাঁই করতে শুরু করেছে। উপায়ন্তর না দেখে দু পাতা হাতে লিখে জমা দিলাম। যৌন উৎপীড়ন কমিটির চেয়ারপার্সন আমার জয়েন্ট সেক্রেটারি মহিলা আবার বাঙালি, তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি কোন অ্যাকশন নিতে চাইছ?’ আহা! নরম সরম প্রাণ আমার। অ্যাকশন নিতে গেলে যদি মাইকেল জ্যাকসন হয়ে যায়? কারুর ছিটলেমোর জন্য তার কেরিয়ারের ক্ষতি হোক আমার মতো স্বাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষের পক্ষে তা হজম করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই বললাম না না। অন্য ডিভিশনে ট্রান্সফার করে দিই, চড়ে খাক। তারপর ফোন থেকে আরম্ভ করে সব কিছু ব্লক করে দিয়ে এখন একটু নিশ্চিন্তি। তবে সেটা কদ্দিন এবং কদ্দুর সেটা সময়ই বলবে।
তবে এই স্বাত্তিক স্বভাবটা আমায় বেশ ভোগাচ্ছে। আরেক উঠতি অফিসারের ছুটির রোগ আছে। তাকে শুধরোবার দায় নিয়েছিলাম। তা সে কদিন আগে অফিস অঞ্চলে জুয়া খেলতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এবং তখন নাকি মদ্যপ অবস্থায় ছিল। কেন্দ্রীয় সুরক্ষা সেনার প্রতিনিধিকে অনুরোধ করে তার জেলযাত্রা রদ করে শুধুমাত্র ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশনের মুখোমুখি বসিয়েছি। কিন্তু তাতেও কোন হেলদোল নেই, জাঠবুদ্ধি বলে কথা। বরং আমার সিনিয়র আমাকে একদিন বলেই দিলেন যে আমি নাকি তাকে লাই দিয়ে লাইকা বানিয়ে দিয়েছি।

জাঠ বলতেই মনে হল, ফালতুকা গল্প অনেকদূর টেনে নিয়ে যাচ্ছি। তার থেকে মূল গল্পে আসি।
অবশ্য যাঁরা জানেন না তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এই যে জাঠ, খাপ পঞ্চায়েত, অনার কিলিং এসব নিয়ে যে সহ কথাবার্তা শোনেন তার একটাও গালগল্প নয়। হরিয়ানার লোকজন গর্ব করে বলেও থাকে যে তারা এমন এক সমাজে বাস করে যা এখনও মহাভারতের যুগে পড়ে আছে।

মহাভারত বলতে মনে পড়ল, মহাভারতও তো জাঠেদের গোষ্ঠী দ্বন্দ বই আর কিছু না। কর্ণের অঙ্গ রাজ্য কর্ণাল। পাণ্ডবদের পাঁচ গ্রাম বাগপত, সোনেপত, তিলপত (ফরিদাবাদ), পানিপত এবং ইন্দরপত বা ইন্দ্রপ্রস্থ। আর হস্তিনাপুর হল বর্তমান মেরঠ। বাদবাকি অন্যত্র শোনাব। জাঠ বিয়েতে ফিরে আসি।

পঞ্চায়েত এবং খাপ বলতে আমরা এই যে খবরের কাগজে যা পড়ি বা টিভিতে যা শুনি সব সত্যি, সঅব সত্যি। ঠুনকো জাতিগত গৌরবের জন্য অন্তজ সন্তানকেও ঝুলিয়ে দিতে তারা পেছপা হয় না।
সোনেপতের এমনই একটা গ্রাম কাম শহরতলির একটি সো কলড শিক্ষিত পরিবারে আমাদের গল্পের নায়কের জন্ম। পরিবারের মধ্যে সবার ছোট, স্মীতহাস, স্বল্পবাক দোহারা চেহারার ছফুট লম্বা ছেলেটি আমি যখন এই ডিপার্টমেন্টে আসি তখন সদ্য সার্ভিসে যোগ দিয়েছে। গত সাড়ে চার বছর ধরে হাতে করে গড়েছি। এখন অফিসার হবার জন্য তৈরী। এমন কি এই যে এবারে ক্রিকেট খেললাম, ছেলেটি বাঁ হাতি পেসার হিসাবে আমার টিমের ওপেনিং বোলারও ছিল। এক কথায় এতদিনে ছোটভাই কাম বড় ছেলের মতো হয়ে গেছে। তবে ভাই হোক বা ছেলে, তাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমি নাক গলাই না।
এখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে আউটসোর্সড কর্মীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অফিসের মধ্যে একটা রঙিন ভাব চলে এসেছে। এখানে ওখানে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। কপোত কপোতীর সংখ্যা বাড়ছে। আর তা দেখে বেশ ভালোই লাগে। তা আমাদের হিরোর সঙ্গে এক সুদর্শনার মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল। তাও ঘুরতে ঘুরতে বছর খানেক।
হঠাৎ গত জুন মাসে ছেলেটি একটা কার্ড দিয়ে জানিয়ে গেল তার বিয়ে। কিন্তু দেখলাম সুদর্শনার হাত রাঙা হল না। আরও একটি প্রেমকাহিনির আলাপেই ইতি বলে ধরে নিয়ে কাজকর্ম করতে শুরু করলাম।
এদ্দিন কিস্যুটি হয় নি। হঠাৎ নভেম্বরের মাঝামাঝি সেক্রেটারির অফিসে জানা গেল, আমাদের হিরোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে হিরোকে এখান থেকে ট্রান্সফার করে দেবার অনুরোধ করেছে।
প্রমাদ গনলাম, হিরো আবার শেষ লীগের ম্যাচেও উপস্থিত হল না। যেদিন এলো জেরা করলাম। আমার সামনে বসে ছেলেটি কেঁদে ফেলল। বলল, তার প্রেয়সীর সঙ্গে বিয়ে হবে না সেটা বুঝেই গেছিল, এবং সেই নিয়ে দুজনের কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা হল হিরোকে ধরে ব্ল্যাকমেল করে তার বাবা মা বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল। ঠাকুমা দাদুর হৃদয় যেকোনো হৃদয়ব্যঞ্জক গল্পের হৃদয়বিদারক সমাপ্তির পথ প্রশস্ত করে। এক্ষেত্রে ছেলেটা চুপচাপ স্বভাবের বলে আরও সুবিধা হয়েছে।
কিন্তু বিয়ের মাস চারেক পরে সে বুঝতে পেরেছে যে তার স্ত্রী তার জন্য যশ চোপড়ার সিনেমার থিম নিয়ে আসে নি। কোন মিলই নেই দুজনের। আমি কুকুর আর তুমি পুকুর, আমি ঢেউ তো তুমি ফেউ টাইপের কেস। ব্যাস তার সব রাগ ভিসুভিয়সের মতো তার বাড়ির লোকের উপর পড়েছে। কষ্টের শেষ নেই। তার উপর বিষফোঁড়ার মতো প্রাক্তন প্রেয়সীকে দিনরাত অফিসে দেখছে। চলন্ত সাইকেলে লোহার রড ঢুকে একসা কাণ্ড।
বাড়ির লোকজন ডাংগুলি খেলতে ব্যস্ত আর শ্বশুরবাড়ি তো ফুটছে। হিরোর বর্তমান স্ত্রীও নাকি বলেছে, ‘হাত প্যায়ের তুড়ওয়াকে ঘর মে বিঠা দো। মাগর ডিভোর্স কা কোই চান্স নেহি!’ পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা কিন্তু পণের অভিযোগ ছুঁলে একদম ৪৯৮ ঘা। তার উপর আবার ক্লজ এ। একেবারে সাড়ে তিন বছরের জেল। নো বেল। অনলি ঢং ঢং গরাদ।
কিন্তু ছেলেটি সে সব বোঝার উর্ধে। তারপর গত মাসের একুশ তারিখ থেকে সে দেখি অফিসেও আসছে না। এক সপ্তাহ পরে তার বাবা এক বন্ধুর সঙ্গে এসে হাজির। তিনি রাজ্য সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মী ছিলেন। হিরোর প্রেয়সীর বাড়ি গিয়ে তাদের হুমকি তো দিয়েইছেন, তার উপর আরও বলেছেন আমার নাকি চণ্ডীগড় ট্রান্সফার করে দেবেন। আমাদের সার্ভিসের তিনকুলে কেউ দিল্লি ছেড়ে কোথাও যেতে পারে নি। আর আমি সেই সম্ভাবনায় বেশ উত্তেজনাই উপভোগ করেছি।
তা তিনি প্রথমে জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে গেলেন। আর তিনি সুড়ুত করে তাঁকে আমাদের দিকে ঠেলে দিলেন। আমরা বলতে আমার ডেপুটি সেক্রেটারি ও আমি। এসেই বলেন আমার ছেলেকে ট্রান্সফার করে দাও। ল্যাহ। তাঁকে বোঝালাম সেটা প্রায় অসম্ভব কারণ কার্মিক বিভাগকে যদি এটা লিখি যে ট্রান্সফার না করলে শ্বশুরবাড়ি ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে বলেছে, তাহলে ডিওপিটি আমারই ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে। এটা কোন কথা হল?
এবার শুরু হল ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং। তাঁর ছেলেকে নাকি তিনজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে। ছেলের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিতে হয়েছে। লুকিয়ে রাখতে হয়েছে পিসির বাড়িতে। আমি প্রেসকিপশন দেখে বললাম এ তো সব ঘুমের ওষুধ। এসব খেলে কি আপনার ছেলে তার প্রেয়সীকে ভুলে যাবে? নাকি ট্রান্সফার করে দিলে সেটা সম্ভব হবে।
তা কে শোনে কার কথা! আমাকে বোঝাবার চেষ্টা হল এসব হরিয়ানার ব্যাপার, শ্বশুরবাড়ি খুব ‘খতরনাক’ (খতরনাক হলে বিয়ে দিয়েছিলে কেন বাওয়া?), ছেলে পাগল হয়ে যাচ্ছে। যেন হরিয়ানা একাই শুধু পৃথিবীতে আর আমরা আলফা সেঞ্চুরির অধিবাসী।
সে যাই হোক, সে সবে কাজ না হলে ফ্যাঁচফ্যাঁচিয়ে কান্না তো রয়েইছে। আমার ডেপুটি সেক্রেটারির সঙ্গে আমার খুব ভালো তালমিল। সে একবার খুব জোরসে বকে দিল। যে বেশি ত্যাণ্ডাইম্যাণ্ডাই করলে আমরা কিসসু করব না।
এই সময় আমার খচ্চর মাথা থেকে একটা সল্যুশন বেরোল। মাথাটা খচ্চর হলে কি হবে মনটা তো নরম! তাই অনেক কষ্ট দুঃখ নিয়ে প্রস্তাব দিলাম, ‘ছেলেটি পার্মানেন্ট, কিন্তু মেয়েটি নয়। মেয়েটি যে কনট্রাক্টরের মাধ্যমে কর্মরতা, তার মাধ্যমেই অন্যত্র যদি কাজে লাগিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। তাতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’। হ্যাঁ মেয়েটির যেন কোনমতেই লোকসান না হয়।
খুবই খারাপ লোক পাঠক পাঠিকা। একতা কাপুরের সিরিয়ালের শাশুড়ি অথবা কয়ামত সে কয়ামত তকের গোগা কাপুর নিজেকে ঠিক এরকমই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিধি নাচার। কারুর কিছু হয়ে গেলে কী হবে?
তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি ঘটবে আশ্বাস দিলাম বটে, তবে এটা জানা যত সহজে সেটা করার কথা ভাবা হচ্চে তত সহজ হবে না। কারণ কন্ট্রাক্টরের তো ইমোশনের ই নেই! তাকে বললে বলবে সার্ভিস টার্মিনেট করে দিন। তবুও পরেরদিন তাকে ডেকে অনুরোধ করলাম যে ভাল দেখে একটা মন্ত্রণালয়ে যেন মেয়েটিকে স্থান দেওয়া হয়। এই সূত্রেই বেরিয়ে এলো নগর উন্নয়ন দপ্তর, যেখানে আমার এবং ডেপুটি সেক্রেটারি উভয়েরই চেনাজানা আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হল বটে কিন্তু কাজ হতে হতে মাস কাবার হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে আবার, হিরোটি নিজের পিসতুতো দাদার ফোন থেকে আমায় ফোন করে জানাল যে সে আর যাই করুক আত্মহত্যা করছে না, যা তার বাবা দাবি করে গেছেন। ও সব নাটক। তাকে একবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম বটে যে সব সময়ের উপর ফেলে রাখলে উলটো কেস হবে। আর এখন এসব ভেবে লাভও নেই। ফল হল উলটো। পিসতুতো দাদা তো বুঝলো, পিসি ছিলেন কাছেই। তিনি ভেবে বসলেন যে আমি ফুসলচ্ছি। সে আর কী বলি, পিসতুতো দাদাকে বললাম ছেলেটার দিকে নজর রাখতে হুড়মুড়িয়ে যেন কিছু না করে বসে।
এভাবেই ছিল বেশ। দিন সাতেক কেটেও গেছে। কাল কোন একটি কাজে বাড়ি দ্রুত ফিরে এসেছি। হঠাৎ দেখি হিরোর বাবার ফোন। আমি তো ভদ্রভাবেই কথা বলতে শুরু করলাম। তিনিও ভদ্রভাবে বলতে বলতেই বললেন, ‘হামারে ঘর মে সব ইয়ে সমঝে হ্যায় কে আপ মূল ষড়যন্ত্রকারী হো। ইসলিয়ে আগার হামারে লড়কে কো ইয়া উস লড়কি কো কুছ হোতা হ্যায় তো হাম তো পুলিশ কো আপ হি কে নাম বতায়েঙ্গে’।
অ্যাঁয়! বলে কি রে! সঙ্গে সঙ্গে খুব শক্ত কিন্তু ধীরে ধীরে বললাম যে আমাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে বিশেষ কাজ নেই। আমি পুলিশকে নিয়ে কবিতা লিখি ( সেই যে লিখেছিলাম না? ‘ওগো আমার পুলিশ, আমায় আলতো করে তুলিস/ শ্যামলা রাতে গামলা হাতে গোবর জল গুলিস/ বৃষ্টি হলে মাঝরাতেতে নিজেরই কান মুলিস।। ইত্যাদি এবং প্রভৃতি) এবং আপনি নিজে একজন ক্লাস ওয়ান অফিসারকে হুমকি দিয়ে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছেন।
যাই হোক, জাঠদের হাঁটুতে এসব ঢোকে না। তারা বেহালার থেকে তবলা বাজাতে বেশি পছন্দ করে। অতএব তিনিও একই সুরে ‘তুম তানানানা’ করে গেলেন দেখে আমি ফোনটা ‘কাটছি এবং ফের ফোন করবার সাহস দেখাবেন না’ বলে কেটে দিলাম।
তারপর আজ অফিসে গিয়ে সোজাসুজি লিখিত দিলাম। ছেলেটিকে চিঠি পাঠালাম ‘অনেক হয়েছে ভাই, রুস্তম সোরাব শিরি ফারাদ খেলা। এবার মানে মানে কাজে এস না হলে চাকরি খোয়াও’। জয়েন্ট সেক্রেটারির অনুরোধে কনট্রাক্টরকে ডেকে আরেকবার বোঝালাম, যে প্রাণ যায়ে পর মেয়েটার চাকরি বাকরি নিয়ে টানা হিঁচড়া হতে দেব না। সে ইনিয়ে বিনিয়ে টাইম চাইল এই মাসের শেষ অবধি।
শেষে, আইনি পরামর্শ অনুযায়ী আমি হয়তো কালকেই পুলিশে লিখিত জানিয়ে রাখব। এদ্দিন ধরে জাঠ জাঠ ভাট বহুত শুনে এসেছি! বাঙালির মাথায় ক্যারা আছে। একবার চটকে গেলে… না থাক! ওসব বলে কী হবে? করে দেখাতে হবে! কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন । মা কর্ম্ফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি। মানে? মানে কর্ম করতে বাধা দিলে মা কদাচ ফল দেবেন না। বরং মা কর্মফল হেতু নিজ হস্ত কর্মণিতে ভূমা ক্যালাবেন! আমেন!

প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ একদম শুরুতে বলেছিলাম, হিন্দিভাষী কারুর সঙ্গে এটা আলোচনা করবেন না। একা খাবে্‌ ভাগ করবেন না। কারণ পিকচার আভি বাকি হ্যায়। সেটা যদি না শোনেন? তাহলে আর কী? ওই ‘হেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি’। ভূমা ক্যালানি! আহ দারুণ একটা শব্দবন্ধনী কিন্তু! আহা!

(১৭৫)

নানা পাটেকরের একটা সিনেমা দেখেছিলাম একবার। পার্থ ঘোষ নির্দেশক। পাশের বাড়িতে এক ভদ্রলোক বৌয়ের জন্মদিন উদযাপন করছেন বলে শব্দে নানার ঘুম হচ্ছে না। তা তিনি ইয়াব্বর একটা বন্দুক নিয়ে গিয়ে গুড়ুম করে হাওয়ায় ফায়ার করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইতনা সন্নাটা না না শোরশরাবা কিঁউ হ্যায়?’ আপাদমস্তক ভদ্রলোক বললেন যে তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন। তাতে নানা জিজ্ঞাসা করল, ‘তো কৌনসা তীর মার লিয়া উসনে জনম লেকে? অউর ইসমে তুমহারা কেয়া কন্ট্রিবিউশন হ্যায়?’

আসলে ঘটনা হল কিছু কিছু মানুষ জন্মসিনিক। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ তো তাদের চাঁদের আলোয় ঘুম হয় না। বাড়িতে আজ নলেন গুড়ের পায়েস রান্না হয়েছে তো ডায়বেটিস বেড়ে যাবে। শচীন সেঞ্চুরি করেছে তো দেশের গরীব মানুষগুলোর থালায় কী ভাত পড়বে? তাদের কাছে বিয়ে করা মানে খরচ, সন্তান উৎপাদন মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সৌন্দর্য্যের ব্যাখ্যান মানে সেক্সিস্ট বাক্যাবলী, পদ্মাবতীর নাম পালটে পদ্মাবত হলে তারা ধোনিকে নিয়ে পড়েন।

সে যা হোক, লেখাটার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফেই একগাদা নেগেটিভ এনার্জি ছড়ানো হয়ে গেল। আসল কথা হল কাল গেছে নতুন বছরের প্রথম দিন। গিনিপিগের মত লোক এণ্ডিগেণ্ডি নিয়ে ইণ্ডিয়া গেটে মোচ্ছব করেছে আর আমার মতো সুরহীন অসুররা সেই নিয়ে সক্কাল সক্কাল আপনাদের সামনে কমপ্লেনের পিটারা খুলে বসেছি।
না না, পাঠক/ পাঠিকারা, ফিসফাস লেখক তেমন নীচমনের কৃমিকীট নয়। আসলে… না থাক! সব কথার জাস্টিফিকেশন দিতে নেই! আসুন গল্পে ফেরা যাক!

তা হয়েছে কি, কাল ছিল সোমবার আর পয়লা জানুয়ারি। অফিসে একটা নিউ ইয়ার্স পার্টি করতে গিয়ে এমনিতেই আমি কালে কালে চলে আসা কালেভা আর বাংলা স্যুইটসের মিষ্টি এবং সামোসার ছুটি করিয়ে দিয়ে লোককে জলভরা তালশাঁস, কেশর ভোগ, ভেজিটেবিল চপ আর ফুলকপির শিঙাড়া খাইয়েছি। তারপর সারাদিনের পাপস্খলনের পরে সন্ধ্যা সোয়া ছটায় নিচে নেমে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়েই দেখি চিত্তির!
আসলে দিল্লি কি সর্দি বলতে যেটা বোঝায় সেটা ৩১শে ডিসেম্বর থেকেই প্রথম মালুম দিতে শুরু করেছে। এতকাল ছিল ধোঁয়াশা আর এখন কুয়াশা! আগেরটা মানবিক পাপ আর এবারেরটা মানসিক চাপ। মানে এবারের ধোঁয়া ধোঁয়া সকালে পল্যুশনের গল্প নেই। নেই ফসল পুড়িয়ে দেওয়ার প্রহর, বা কন্সট্রাকশনের ধূলিমেলা। এ হল আদি অকৃত্রিম দিল্লির কুয়াশা। এক মিটার দূরে যদি একটা পাগলা ষাঁড়ও নিশ্বাস ছাড়তে থাকে তাও তাকে দেখতে পাবেন না। সেই কুয়াশা ঘেরা সকাল কালকে নতুন বছরকে আলিঙ্গন করে দিল্লির বুকে চাদর ছড়িয়ে দিল। অতএব হেডলাইট আর ফগলাইট জ্বালিয়েই প্রভাতি সফর শুরু। আর অনভ্যাসবশতঃ অফিসে পৌঁছে সেটা নেবাতে ভুলে যাওয়া।

আর ফলে, সন্ধ্যায় গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে ফুসসস! ব্যাটারি ডিসচার্জ করে দিয়েছে। সোয়া ছটায় ফোন লাগালাম ডাটসনের রোডসাইড অ্যাসিস্ট্যান্সে। তারা বলল আপনার কাছে এসএমএস এখুনি আসবে আর অ্যাসিস্ট্যান্স হাজির হবে এক ঘন্টায়। এক ঘন্টা আর মানুষের জীবনে কি এমন ব্যাপার। সে তো গাড়িতে বসে ঘুমিয়ে গেয়ে চলে যাবে। তবে চা তেষ্টাও পেয়েছে মন্দ না। শীতের ধোঁয়া ভরা সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা মুডটার সারেগামা রাঙিয়ে দেয়। সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে টুকটুক করে হেঁটে গেলাম নেহরু স্টেডিয়ামের গায়ে রোড সাইড টি স্টলে। এদের প্রতি আমার বিশেষ অভিযোগ, কড়ক চা বললে ছাতা চিনি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। এখানে এক মহিলা, তাঁর দেড়-দু বছরের ছোট ছেলেটিকে নিয়ে চায়ের দোকান গোটাবার তোড়জোড় করছেন। তা কেটলি রাখা গরম চায়ের মতোই আমার ভাগ্যে জুটল। সে মন্দ না। সুদু এলাচের খোসার টেস্ট নয়, তাতে গুঁড়ো চায়ের খোশবাইও পাওয়া যাচ্ছে। তো তাতে তো মিনিট দশেক। বাকী পঞ্চাশ মিনিট?
এখন আবার মোবাইলে নতুন আপ ডাউনলোড করেছি স্টারমেকার। স্টার ফার গুলি মারুন, ক্যারাওকেতে ক্যাঁত মেরে গাইলে ফুসফুসে অনেকটা অক্সিজেন ঢুকে যায়। তাতেও ‘তুমি যাকে ভালোবাসো স্নানের ঘরে ডিস্কো নাচো’ ইত্যাদি গেয়ে গড়িয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা পৌনে আটটা। একের জায়গায় দেড় ঘন্টা। বেশী এদিক ওদিক করতে পারছি না। সিকিউরিটি গার্ডরা বেশ সন্দেহের চোখেই দেখছে। সন্ধ্যাবেলায় সন্দেহ কাটাতে খামোখা খেজুর জুড়লাম। এর মাঝেই একবার ফোন করে নিয়েছি। এবারে খোদ মেকানিকের সঙ্গে বার্তালাপ ঘটেছে। সে আবার লোদি গার্ডেনের দিকে নাকি চলে যাচ্ছিল। ঠিক সময়ে তাকে ঠিক বুঝিয়ে ভুল বোঝাবুঝি থেকে বিরত করলাম। দশ মিনিটেই সে পৌঁছে যাবে। কী আনন্দ!

এদিকে ঠাণ্ডা তো ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে। টহলদারি প্রহরীদের সঙ্গে তখনও ‘বেইমান দুনিয়া’ নিয়ে বার্তালাপ চলছে। আর ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে আটটা কুড়ি। এরই মধ্যে আমার অফিসের কেয়ারটেকার ছেলেটি হাজির। বাড়ি যাচ্ছিল। মেন গেটের সামনে আমায় দেখে সত্যিকারের চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমায় বলল সাড়ে ছটায় বললে কাউকে না কাউকে হাজির করত। চেষ্টা অবশ্য করল। কিন্তু সাড়ে আটটায় যখন তাপমাত্রাই সাড়ে পাঁচ তখন সে সব চেষ্টার দাম থাকে না। আমি নিজেই ফোন লাগালাম অ্যাসিস্ট্যান্সে। সেখান থেকে মেকানিকের সঙ্গে কথা হল। সে এবার সত্যিটা ফাঁস করল- ভয়ানকভাবে ফেঁসে আছি স্যার। ফরিদাবাদ থেকে আসছিলাম, এখনও আধ ঘন্টা লাগবে কম করে, লোকে ঝেঁটিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নিউইয়ার্স ডে সেলিব্রেট করতে’। অ্যাই, এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে… জাস্ট কিসসু করার নেই।

কেয়ারটেকার ছেলেটি, নাম তার চন্দন! আহা ‘চন্দন চন্দন! দৃষ্টিকে কী শান্তি দিলে চন্দন চন্দন!’ সে আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকল। হাঁটতে আরম্ভ করলাম এক কিমি দূরের বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে, ওলা উবারে কল করা হয়ে গেছে। মোচ্ছবের রাত্রে তারা শেয়ার বা পুলেও চাইছে সাড়ে চারশো টাকা। পাগলা না ওমর আবদুল্লা? একটা অটো দেখা যাচ্ছে না? হ্যাঁ তাই তো! চন্দনকে বারবার বলছি পৌনে নটা, বাড়ি যা ভাই! কিন্তু দায়িত্বশীল ছোট ভাইটির মতো আমাকে অটোতে না চড়িয়ে সে যাবে না।

আর অটো? সে এক অটো মহায়। অটো ওলাকে দেখতে ঠিক টিনু আনন্দ আর নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির ক্রস। সে কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ‘একশো কুড়ি লাগে একশো পঞ্চাশ দেব’। আর আমি কিছু বলার আগেই সে ভ্যারভ্যারিয়ে বলল, ‘আপনি যা বলছেন তা সর্বৈব্য সত্যি মি লর্ড, কিন্তু আজকের দিনে বৃষস্কন্ধ জ্যাম লেগেছে জায়গায় জায়গায়। ভারতের জনসংখ্যার নব্বই শতাংশ ইন্ডিয়া গেটে উঠে এসেছে। অতএব স্যার কুড়িটা টাকা বেশী দেবেন’।
তর্ক চলে না মাই ডিয়ার ওয়াটসন। হ্যাঁ বলে বসতে গিয়ে দেখি ব্যাকরেস্টটা নামানো, চলন্ত গাড়িতেই সেটাকে ঠিক করে সবে ঝিমোতে যাব কি যাব না। নওয়াজ শুরু করল তার অটোযাত্রা। যাত্রা মানে? পুরো শান্তিগোপাল! বাসরে। ভোঁ করে গাড়ি চলতে শুরু করল। জ্যাম ছিল তো গুড়ুম করে ফুটপাথে উঠিয়ে ভ্যাঁভুঁ হর্ণ দিতে দিতে ছুটল। ফাঁক পেলেই বিড়ি খাচ্ছে। আর আমার তখন কল্পতরু অবস্থা। শান্ত হয়ে বসে আছি, ঠিক যেন শেষ বিচারের আশায় ইন্দিরা ঠাকুরুণটি।‘ও বৌ দুটো মুড়ি দিবি!’ অটো তখন একটা হোন্ডা অ্যাকর্ড আর একটা মাহিন্দ্রা বোলেরোর মাঝখানের দেড় মানুষ সমান গ্যাপটা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটছে। আর আমি যেন হালকা হয়ে স্লো মোশনে চলছি। মানে আমার তো চলার কোন অবস্থাই নেই যা চালাচ্ছেন, তিনিই চালাচ্ছেন।

আর কি ঠাণ্ডা রে ভাই। কী ভাগ্যিস আমি একখান টুপি গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম আর আসার সময় সেটা নিয়ে এসেছি। তা সেটা দিয়ে কান তো ঢাকা গেল, কিন্তু নাক? অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি আমার মুলোর মতো নাক গাজরের মত লাল হয়ে জমে যাচ্ছে, এরপর হয়তো ব্ল্যাক কারান্ট আইসক্রিমের মতোই ভেঙে পড়ত। কিন্তু ঘড়ি ঘুরতে না ঘুরতেই গাজিয়াবাদ বর্ডারে এসে গেলাম পৌনে দশটায়।
তারপর আর কি, এক কিমি রাস্তা গা গরম রাখার জন্য দৌড়েই পৌঁছে গেলাম। তারপরের গল্পটা পরের প্যারাগ্রাফে।

এ গল্পটা আজকের, আজ তাড়াতাড়ি অফিসে এসে গাড়িটিকে গতিশীল করতে হবে, তাই হড়বড়িয়ে হেঁটে মেন রোডে এসে উবারে অ্যাপ লাগালাম। বলে ৯৯ টাকা! এবাবা এ তো পুরো শান্ত শিষ্ট যিশুখ্রিস্ট। হলই নাহয় উবারপুল। তাও ৯৯ টাকায় তো হাতে পাশবালিশ। ফট করে রাজি হয়ে ক্লিক করে দিলাম। এবার শুরু হল আসল খেল, আমি গাজিয়াবাদের বাইরে এসে গেছি। কিন্তু উবার থেকে সমানে গাড়ি দিয়ে যাচ্ছে গাজিয়াবাদের, যারা অতি অবশ্যই দিল্লি আসার জন্য একশো টাকা দেবে এবং আবদার করছে যে সেটা আমাকেই দিতে হবে। ল্যাহ! পরপর পাঁচটাকে বাতিল করে, আবার অটোতে চড়ে অফিসে এলাম হাতের পাতা জমিয়ে। এসেই একটা বিলে সাইন করার জন্য নিয়ে এলো। সাইন করতে গিয়ে ‘এস’ লেখার জায়গায় এস সার্ভিস করে বসলাম। পেন আর পাক খেলো না সোজা পগারপার। হাত পেনটাকেই অনুভব করতে পারছে না।

সে যা হোক, সেই সঞ্জীব ঝা (ওহো বলা হয় নি বুঝি! সেই নিশান/ ডাটসন অ্যাসিস্ট্যান্টের নাম) আমাকে আশ্বস্ত করে ব্যাটারি চার্জ করে দিলেন আর কল ক্লোজ করলেন। আর আমাকে পরে যেতে যেতে বলে দিলেন যে কাল ছেলেপুলেগুলো বলছিল একটু বেড়াতে যেতে, কাজের জন্য যেতে পারি নি। আজ সন্ধ্যা থেকেই থাকব ইন্ডিয়া গেটে, ছেলেপুলেগুলোকে নিয়ে। আপনার গাড়ি স্টার্ট না হলে কল মেরে দেবেন প্লিজ’। আহা ভাগ্যিস কালকে ‘অপোগণ্ড’ বলে গাল পেড়ে অভিযোগ করি নি। লোকটার দিলটা একদম সার্ফ এক্সেল দিয়ে সাফ করা।
এই আর কি! এসব নিয়েই ফিসফাসের গাড়ি চলছে, আর আপনাদের নতুন বছরটাও চলতে থাকুক। ভালোয় মন্দয় মেশানোই হোক, শুধু যেন মন্দর সঙ্গে দ্বন্দ করার আর ভালোকে ভাগ করে নেবার শক্তি থাকে। আবার দেখা হবে। হয়ত কালকেই, একটা জাঠ বিবাহের গল্প নিয়ে। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢ্যানটান্যান, ঢিঁচকাও!

(১৭৪)

আধুনিক বাঙালি জন্মের আদিকালে আমাদের কবিগুরু (আমি একবার ২৫শে বৈশাখে অর্কুটে রবিগুরু কবিন্দ্রনাথ লিখেছিলাম বলে এক রবীন্দ্রানুরাগী আমায় বেশ রাগী রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল, “Y so serious!” ), সে যাগগে! যা বলছিলাম, কবিগুরু ভারততীর্থে লিখে গেছেন ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে…এই ভারতের মহামানবের ইত্যাদি ও প্রভৃতি’। ব্যাস সেদিন থেকে বাঙালির চাপের শুরু। বাঙালি সবার আগে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মিলিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকে।
কোন এক ফিসফাসে লিখেছিলাম বোধহয়। কোন বাঙালিকে দেখবেন না, রেস্টুরেন্টে গিয়ে পুঁইশাক চচ্চড়ি আর মোচার ঘণ্ট দিয়ে স্টিলের থালায় এক পাহাড় ভাত সাবড়াচ্ছে। সেসবের জন্য তো বাড়ির টেবিল বা মেঝেই আছে।
অথচ, তামিলরা পরোটাকে সটাং তামিলীয় বানিয়ে খায়। তাদের কাছে রোটি আর চাপাটি আলাদা আলাদা। গুজরাটিরা যে কোন রান্নায় একঘটি চিনি দিয়ে তার মোদীফিকেশন করে ফেলে।
একবার এক রাজস্থানী রেসর্ট কাম রেস্তোরায় মাটিতে বসিয়ে টুলের মতো পিঁড়ি দিয়ে ইয়াব্বড় পাগড়ি পরিয়ে থালায় খিচুড়ি দিয়ে ছ্যারছ্যার করে ঘি আর ভুরভুর করে গুড় দিয়ে বলে ছিল ‘খাও সা!’ আর খাও সা! খাওয়া তখন মাথায় উঠে ভদ্ভদ করছে। ঘিয়ের সমুদ্রে গুড়ের পাহাড়ে বেচারা খিচুড়ি তখন মরোমরো অবস্থা। তারপর বেসন, আর শুকনো লঙ্কার বিভিন্ন পোজের পদ পিটিয়ে কোনরকমে ছুটি।

আর পাঞ্জাবী? তাদের নিয়ে কোন কথা হবে না। তারা কিচেন কিং মশালা দিয়ে ম্যাগি, ফুলকপি দিয়ে মাঞ্চুরিয়ান, সয়াবিন দিয়ে চাঁপ, পালং শাক দিয়ে গিলাওটি কাবাব বানিয়ে ফেলে। নবরাত্রির সময় মশালা দোসায় নির্নিমেষে পেঁয়াজের পরিবর্তে বাঁধাকপি চালিয়ে দেয়।

সেই তুলনায় বাঙালিরা উত্তরপ্রদেশে টিকিধারী ব্রাহ্মণ, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা সাপোর্টার, তামিলনাড়ুতে তামিল অথবা বড়জোর তেলেগু বা কন্নড়, বিহারে বনফুল, ভাদুড়ি বা শরচ্চন্দ্র। খাপ খোলে কেবল ওড়িশা বা আসামে। তাও সেখানে খোলা খাপের চোটে এখন একটু ব্যাকফুটে।
বাকীদের কথা ছেড়েই দিন, এই যে আমি এদ্দিন ধরে দিল্লির ঊষর বাঞ্জর জমিতে পড়ে আছি। কথা বলতে আসুন, প্রথমেই মনে হবে লেঠেলের বাড়ি ছাতু খাবার নেমন্তন্নে এসেছেন। দাঁত বার করাটা সেখানে জাস্ট বাহুল্য, ভুরু সবসময় পরশুরামের ধনুকের মতো কুঁচকে আছে।

তা সেসব তো গেল। কথা হচ্ছিল পাঞ্জাবীদের। পাঞ্জাবীদের চিনতে গেলে আপনাকে পাঞ্জাবী বাগে যেতে হবে না। উত্তর বা পশ্চিম দিল্লির রইসি কলোনিগুলোতেও যেতে হবে না। রাস্তায় যেতে যেতে কোন উচ্চনাশা এবং লাউড মিউজিক সম্পন্ন গাড়ি আপনাকে তোয়াক্কা না করে ভুশ করে বেরিয়ে গেলে জানবেন সেটা খান্না, কাপুর, দুদেজা, টুটেজার গাড়ি। কথায় কথায় ‘মেরা বাপ কোন হ্যায়?’ মার্কা সাধারণ জ্ঞানের কোশ্চেন শুনতে পেলে বুঝবেন, অরোরা, শর্মা, আনন্দের সঙ্গে কথা বলছেন। আর বিয়েবাড়িতে গেলে যদি দেখেন সাটলনেসের সাটলকককে শেহবাগ স্টাইলে কেউ বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে তাহলে বুঝবেন তা ভাটিয়া পশরিচার বাড়ির বিয়ে।

তা কালকেই গেছিলাম একটা বিয়েবাড়িতে। এই বিয়ে বাড়িটা আমি মাঝে সাঁঝে মায়াপুরী যেতে আসতে বার কয়েক দেখেছি। গ্রেট ড্রিমস। বাইরে পিলারে অ্যাডোনিস, অ্যাপেলো আর অ্যাটলাসের ছড়াছড়ি। দেখেই মনে হতো প্লাস্টিক কিনা! তা কাল গিয়ে দেখলাম প্লাস্টিকের নয় প্যারিসের প্লাস্টারের।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি এই বিয়েটি আমার অফিস কলিগের ছেলের। তা সপরিবারে গেছি। ছেলেটা প্রথমবারের জন্য একটা জম্পেশ উত্তরাঙ্গ বন্ধগলা পরেছে। আর মেয়েটি তো গাড়িতে উঠেই ঢ্যাং করে ঘুমিয়ে পরেছে। ভিতরে ঢুকতেই দেখি এ দেওয়াল ও দেওয়াল নাম না জানা নীল নয়না আর শৌর্যবীরদের ছবির ছড়াছড়ি।

আমার এক অফিস কলিগের সঙ্গে বাজি রাখা ছিল যে বিয়েতে আমিষ থাকবে না। পাঞ্জাবীরা তন্দুরি চিকেন ছাড়া আহ্নিক পর্যন্ত করে না, কিন্তু বিয়ে বা অন্য নিমন্ত্রণ বাড়িতে আমন্ত্রিতদের ডেকে ডেকে কমলকাঁকরির সবজি আর সয়াবিনের ম্যানেকিন খাওয়ায়। আপনি চিকেন লেগপিস, কাকোরি কাবাব বা ফিশ ফিঙ্গার খেতে পছন্দ করেন? আপনার জন্য আছে সয়াবিন লেগপিস, আলুর কাকোরি কাবাব অথবা র‍্যাডিশ ফিঙ্গার। সবকটা আসল আমিষাশী খাবারের নকল। অথচ দেখা হলে জিজ্ঞাসা করবে অসূর্যম্পশ্যা দৃষ্টিতে, “ইয়ে চিকেন কা সোয়াদ ক্যায়সা হোতা হ্যায়? পনীর য্যায়সা?” অপোগণ্ড কোথাকার!

তা বিয়েবাড়িতেও কর্ন আর গাজরের সুশি, কমল কাঁকরি চিপস, গোবি মাঞ্চুরিয়ান এনে হাজির করেছে। পেগের তো এদিকে ছড়াছড়ি। আমরা বরপক্ষের কিন্তু বরের দেখা নেই। নটায় আসার সময় আমরা ঠিক পঞ্চাশ মিটার দূরে তাদের আবিষ্কার করি। আর যখন ফিরে এলাম তখনও তারা বর আগে না বরের বাবা আগে, সেই নিয়ে আইস বাইস খেলে যাচ্ছে। আর মেয়েদের কথা তো ছেড়েই দিন। তাদের পোশাক এবং মেকআপে যাহা চকচক করে তাহাই সোনার সমারোহ। এমনকি মাথার চুলও পর্যন্ত চকচক করছে। ছেলেগুলো বিরাট কোহলির (আনন্দ বাজার যতই বলুক ওটা কোহলিই!) দেখাদেখি ডিজাইনার দাড়ির চাষ করে, আর ডিজাইনার বন্ধগলা, শেরওয়ানি, কোট ইত্যাদিতে একদম রাজকীয় পরিবেশ।

এসব ছাড়িয়ে ঢোকার মুখে মেয়ে বলল ঠাণ্ডা লাগছে, তাই হাফ জ্যাকেট পরে ভিতরে গেল। যাবার আগেই জিজ্ঞাসা করে গেছে, ‘নাচার কাঁচটা আছে তো?’ ডান্সফ্লোর! ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারল জ্যাকেটটা প্রতিবন্ধকতা। সেটা পটাং করে খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল ডান্সফ্লোরে আর ছেলে গেল স্ন্যাক্সফ্লোরে। আমি আর পার্শ্ববর্তিনী তখন মেয়ের জ্যাকেট আর গিফটের বেডকভার নিয়ে জাগলিং করে যাচ্ছি। এই গিফট একটা মজার ব্যাপার। আজকাল আবার গিফটের প্রত্যুত্তরে রিটার্ণ গিফট হয়েছে। দিবে আর নিবে। না লইয়া দিবে না। রবি কবির কথাগুলো বাংলা না বুঝেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে।

তা আমার বিয়েটাও এখন কচি, বছর পাঁচেক হয়েছে সবে। সেখানে একজন পরিচিত নিজের নাম লিখেই একটা পুরনো এবং খারাপ হয়ে যাওয়া স্যান্ডুইচ মেকার গছিয়ে দিয়েছিল। বাদবাকী তো ঠিক আছে, এতো ভালো ভালো বেডকভার পাওয়া গেছিল, এখনও প্রত্যেকদিন পাল্টেও সব বেডকভার পাতা হয়ে ওঠে নি! (এটা একটু বাড়াবাড়ি, তা আপনাদের হাসির কিমতের বিনিময়ে এটা কিছুই না!)
তা এই বিয়েতে একটা দারুণ বেডকভারের সেট নিয়ে ছেলেকে দিয়ে প্যাক করে নিয়ে গেছি। কিন্তু সেটাই হয়েছে বাঁশ। এমনিতে এখানে পাঞ্জাবী বিয়েতে টেবিলের উপরেই খাম দেওয়ার চল, তাতে একটাকার কয়েন সাঁটা থাকে আর আপনার রেস্ত অনুযায়ী যা পারবেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাগজ ভরে দেবেন। তাতেই গোনাগুন্তি হিসাব নিকাশের পোয়া বারো। তার কতটা যে বরবউএর হাতে যায় আর কতটা ডেকরেটর আর ক্যাটারারের কাছে সে নিয়ে আমাদের ভেবে কাজ নেই। সদ্ব্যবহার হলেই হল।
তা সময় বাড়ছে, বরযাত্রী তখনও রাস্তা জুড়ে শো চালিয়ে যাচ্ছে। চার ঘন্টায় চার হাজার টাকা! যতটা পয়সা দিয়েছেন ততটা তাসা বাজবে আর ততটাই মোটকানন্দন আর মুটকিনন্দনীরা কোমরের একশো আটষট্টি করবেন। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসের কলিগদের সঙ্গে কতক্ষণ আর হ্যা হ্যা করা যায়। ঘুরেফিরে সেই অফিস পলিটিক্স। সুইচ অফ করাই যায় না। তাই গেলাম পেটে কিছু ফেলতে। সকালে একটা পার্টি ছিল, তাই বাঁচোয়া। বিয়েবাড়ির বরাদ্দ পাঁঠা আর জলজ প্রাণী সেখানেই সাঁটিয়েছি। এখানে খালি ডিজাইনার থালি হাতে অ্যামেরিকান আঙুর আর আনারসে মনোরঞ্জন করে যাচ্ছিলাম। খাবো কী? সবেতেই তো ক্রিম আর ঘি, রুটি, নান, পরোটা, মক্কে দি রোটি, সর্ষো দা শাগ, মালাই কোফতা, লা জওয়াব ছোলে, আলু মেথি, আলু হিং, কাশ্মীরী দম আলু, পনির পসন্দা, পনির পাঞ্জাবী, পনির শেরওয়ানি, ভেয় কি সবজি (কমল কাঁকরিই) পালক কর্ন। এসবের মধ্যে থেকে বাঁচিয়ে বুঁচিয়ে নিয়ে সবে টেবিলে বসেছি।

ওব্বাবা শোনা গেল বরযাত্রী গেটে আর ডান্স ফ্লোরের মিউজিকের মাত্রা গেলো বেড়ে। ‘পটোলা, পাঞ্জাবণ, পাটিয়ালা’ আর কিলো খানেক ওঁহ আর উহ! এই হয়েছে আজকের পাঞ্জাবী হিপহপ। লোকায়ত পাঞ্জাবী লোকগানে মেহেন্দির মাধুর্য এখন টন টন ডিস্কো বিট আর ঝিনচ্যাক পূজার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

মেয়ে নাচছে, খাচ্ছে আবার খাচ্ছেও না। হঠাৎ দেখি ডান্সফ্লোরে সে নেই। খুঁজতে গেলাম এদিক ওদিক। নিজের কথা নিজেই বুঝতে পারছি না। মাথা দপদপ করছে, কান আর জান দুইই ফড়ফড় করছে মিউজিকের ম্যাগ্নিচিউডে। এরই মধ্যে বরের মাতা এবং আমার অফিস কলিগকে আবিষ্কার করা গেল। আইসবাইস পেরিয়ে তিনি ভিতরে ঢুকেছেন। আমি বেডকভারের প্যাকেট নিয়ে তাঁর দিকে ধাবিত হলাম দেখে হাসলেন আমিও তারপর আমি লন্ডন আর তিনি টোকিও নিয়ে বার্তালাপ সারলাম। বেশ বার তিনেক গিফটটি গছাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম, কয়েনওলা খাম ছাড়া তিনি আর কিছুতে ইন্টারেস্টেড ফিল করছেন না, শেষে লোক চক্ষুর আড়ালে গিফটটিকে রেখে ফিরে এসে দেখি পার্শ্ববর্তিনী মেয়েকে আবিষ্কার করেছেন নতুন করে। সে নাচতে নাচতে ভয়ঙ্কর উত্তেজিত এবং মাথার ক্লিপ খুলে গেছে বলে সজল নয়না। খাবার টেবিলে দেখি প্লেট গায়েব আর আমার চেয়ারে মেয়ের জ্যাকেটটিকে স্বচ্ছন্দে চেয়ারের কোনে ঠেলে দিয়ে জায়গা রাখার অ্যাইসি কি ত্যাইসি করে জীবন্ত ম্যানেকিনরা বসে পড়েছেন। জ্যাকেটটি কোন রকমে উদ্ধার করে বীটের হালুয়া এক চামচ মুখে ফেলে কোনরকমে বাইরে এলাম, লিচুচোর কবিতার মতই যেন প্রাণ আসল ধরে। এরই মধ্যে বুঝতে পারলাম টয়লেটের ডাক পড়েছে, পার্শ্ববর্তিনী বলল ‘আমি বাইরেই স্বচ্ছন্দ ওর ভিতরে একদমই ঢুকছি না’!
টয়লেট খুঁজতে গিয়ে দেখি বরযাত্রীরা তখন লাইন দিচ্ছে পাগড়ি পরে আর ওদিকে কনেকর্তারা এবং গিন্নিরা হাতে ফুল আর কিসব কিসব নিয়ে হাজির। সেখানেও কে কাকে দেবে এসব নিয়ে হিসাব কষাকষি চলছে। দাঁড়ালাম না! না হলে আমার ব্লাডারই কষে যেত। হালকা হয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে কোন রকমে গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে চালিয়ে দিয়ে শান্তি। ভিতরে কেউ হালকা করে কথা বললেই বলছি, ‘একটু আস্তে!’ কান তখন স্বাভাবিক অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি। সে যা হোক। ভেজ বিয়েবাড়ির সুখস্মৃতি (?) সেখানেই রেখে আমরা গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। জিস রাত কি সুবহ নেহি ও কভি না কভি তো খতম হোগা হি! ঠিক কিনা? ঠিক ঠিক!

(১৭৩)

আজ ভোরবেলার স্পেশাল স্বপ্নময় ঘুম ভেঙে গেলো চিল চিৎকারে। কেউ মাইক নিয়ে প্রবল জোরে কিছু করার চেষ্টা করছে। আমার অভ্যেস আছে গুরুপরবের দিন কিন্তু আজ সত্যিই চমকে গেলাম। ঘড়িতে দেখি বাজে সাড়ে পাঁচটা আর ‘রাধে রাধে’ করতে করতে একদল বেসুরো লোক সুরে গাইতে গাইতে এলো আর চলে গেল। পার্শ্ববর্তিনী এমনিতেই তার মিনিয়েচার সংস্করণের নানান আবদারে মাঝরাত পেরিয়ে নিদ্রায় যান। তার উপর সাড়ে পাঁচটায় ক্যাকোফোনি শুনে হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন,” ‘আশারাম! আশারাম!’ করে চেঁচাচ্ছে কেন?”
আমি ততক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছি ভাল করে বুঝলাম ওটা ‘আ যা শ্যাম’! তারপর এই ক্যাকোফোনির মানেটা খোঁজার চেষ্টা করলাম। এক পুরুষ কণ্ঠ, যা কিনা সামান্য সুরেলা তিনি গেয়ে চলেছেন জি শার্পে আর তাঁর ঠিক পরেই এক মহিলা কণ্ঠ একই লাইন বি ফ্ল্যাটে মারছেন। আর সুরের ধান হামানদিস্তায় মাড়াই হচ্ছে।

ছেলেবেলায় আমার মেজমাসির বাড়ি যেতাম নীলমণি মিত্র স্ট্রিটে। তা মাসির বাড়ির ঠিক মুখোমুখি একপাল গুজরাটি থাকত। তখন আসলে গুজরাটি, রাজস্থানি, বুন্দেলখন্ডী, বিহারী, ইত্যাদি সকল প্রকার আমিষ অসেবনকারীকে ‘মাওড়া’ বলেই জানতাম। আমার এহেন জাতিবিদ্বেষী মনোভাবকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু সত্যিই ছেলেবেলায় সাদামনে কাদা ছিলনা।
সে যা হোক, তা সেই মহান গুজরাটিরা প্রতি সন্ধ্যায় ইষ্টনাম জপ করতেন একত্রিত হয়ে। এবং বিশ্বাস করুন! এত্ত কুৎসিত বেসুরো আমিও গাইতাম না কোনকালে। তাই শুনিও নি। পরবর্তীকালে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, ‘এ হল কৃচ্ছসাধনের অপর রূপ। যা কিছু শ্রুতিমধুর, তা মনে হয়ে ভগবানের চিত্তবৈকল্য ঘটাতে পারে। তাই পরম ভক্ত, চরম কর্কশ স্বরে গান ফায়ার করছেন’ এরকম টাইপের কিছু।

তা সে তো প্রসেশান করে এসেছিল আবার তেমনই চলে গেল। আর আমার ঘুমটা গেল ভেঙে। আর ভেঙেই বুঝতে পারলাম কোমরে একটু ফেভিকলের অভাব ঘটেছে, তাই একটা চ্যাটচ্যাটে ব্যথা।

আসলে হয়েছে কি, ছেলে ছোকরাদের উৎসাহে আবার করে সেক্রেটারিয়েট লীগ খেলতে নেমেছি। প্রায় বছর নয়েক পরে। এই মন্ত্রণালয়ে এর আগে ক্রিকেট টিম ছিল না। এবারে তাদের উৎসাহে যে টিমটা বানানো হয়েছে তাতে আবার সিরিয়াস ক্রিকেট খেলোয়াড়ের অভাব।
ছেলেপুলেরা খেলেছে। কিন্তু ওই আর কি! দুজনের মাঝখান দিয়ে বল গেলে এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ! সব বল বাউণ্ডারির বাইরে ছ বলে ছত্রিশ মারার ইচ্ছা রাখা ব্যাটসম্যান সব, কিন্তু আসলে কাপ আর ঠোঁটের মধ্যে খোঁচা লাগা না লাগার ফারাক। আর বল হাতে ধরিয়ে দিলে সবাই শোয়েব আখতার। খাঁইমাই ছুটে এসে হাঁইমাই বল ফেলছে। এরই মধ্যে দুটোকে বুঝলাম যে সিমটা সোজা ফেলতে পারে। একটা বাঁ হাতি। তার বলটায় একটু গ্রিপ ঠিক করিয়ে দিতেই দেখলাম ডান হাতি ব্যাটসম্যানের ভিতরে আসা শুরু করেছে। আর একটা সাক্ষাৎ টমসন! চাকার মতো হাত ঘুরিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে আউটস্যুইং করে। আর বাকিদের কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাটিং?

একটা আমার থেকে সামান্য কম বয়সী অফিসার আছে, সে মোটামুটি কাজ চালিয়ে দেবে ব্যাটিং আর বোলিং দুটোতেই ওপেন করে। আর আরেকটা আমার পুরনো মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সহযোদ্ধা। ব্যাটে বলে করে ফেলতে পারে। আর বাকী যা সব আছে, তাদের সিনিয়র অফিসারদের কাছে ফাইল পুট আপ করতে করতে আত্মবিশ্বাসই হয় নি ঠিক মত।

আমার ইতিহাসটা বেশ করুণ এ বিষয়ে। পুরাকালে কেন জানি না আমার কোচেদের মনে হয়েছিল যে আমি বাঁহাতি স্পিনার, তো সেটাই ভালো করে করতে হবে। ব্যাটিং করতে হবে না। সবই করতাম কিন্তু ব্যাটিং করতে দিত না। ফলে সঠিক ব্যাটসম্যানে রূপান্তরিত হতে পারিনি কখনই। ওই কাজ চালানোর মতো করে ব্যাট চালিয়ে দিতাম। পরে স্কুল বা কলেজের ম্যাচে ওপেন করার ফলে প্রোমোশন হয়েছিল নাইটওয়াচম্যান হিসাবে। ব্যাস ওখানেই আটকে যায়। কিন্তু দিল্লিতে এসে বুঝতে পারি ব্যাটিংটা আদতে খুবই সহজ জিনিস, অজটিল ব্যাপার। মানে তোমার পজিটিভ আর নেগেটিভ বুঝে গেলে নেগেটিভকে ডিফেন্স দিয়ে আটকে দাও আর পজিটিভের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রান কর। এইভাবে মোটামুটি সফল হয়ে চলছিলাম।

তা এমতবস্থায় আবার সেই বুড়ো বয়সে ওপেন করতে রাজি হয়ে গেলাম। একে ক্যাপ্টেন, আর তার উপর শুধুই ক্যাঁচা ব্যাট চালাই না। আব্বার কী! হাঁটুতে ক্রেপ জড়িয়ে নিক্যাপ পরে ওপেন করতে নেমে পড়া। আর স্লেজিং? ছেলেবেলায় একবার শুনে শিখে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে ফেলেছিলাম বলে মা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার বাবা বলে?’ সেই থেকে বাপের সম্মান রক্ষার্থে ওসব আমি ঠিক পাবলিকালি বলে উঠতে পারি না।

কিন্তু স্লেজিং মানে কী গালাগালি শুধুই! স্লেজিং এর অস্ট্রেলীয় মানে তো মেন্টাল ডিসইন্টিগ্রেশন। মানসিক ন্যালপ্যালেকরণ। তা সে তো অন্যভাবেও হয়।
তা এসব নিয়েই ময়দানে নেমে পড়লাম। আর পড়বি তো পড় প্রথম ম্যাচেই আমার পুরনো মন্ত্রণালয় মানব সম্পদ উন্নয়ন।

টস! জিত! ব্যাটিং সক্কাল সক্কাল। বেশ কথা। দেখলাম ব্যাটে বলে হতে শুরু করেছে। কিন্তু যেই দু ওভারে একুশ উঠে গেছে আমি দুটো চার মেরে দিয়েছি, ওব্বাবা ওপ্রান্তে ভটাভট উইকেট পড়া শুরু হল। পরপর দুটো। একজন গার্ড নিল ‘টু লেগ’! নিয়ে মিডল স্টাম্পে দাঁড়িয়ে শাফল করে অফস্টাম্পের উপর উঠে এল। নিট ফল পিছন দিয়ে বোল্ড। তারপর যে এল সে দেখি ভয়ানক নার্ভাস। সেদিন মিনিস্ট্রির পার্লিয়ামেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং আছে আর সে পার্লামেন্ট সেকশনে কাজ করে। খালি ভয় পাচ্ছে ‘এই বুঝি ফোনে ডাক এল’! ব্যাট করতে গিয়েও একই অবস্থা। বল স্যুইং করছে বলে বললাম, ‘আগে আকে খেল না’! মানে ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে স্যুইংটা সামলাতে। ওবাবা সেও দেখি অফস্টাম্পের দিকে এগিয়ে গেল। ফলাফল যা হবার তাই হল। আরও তিনটে চলে গেল।

তারপরের ছেলেটা বড়ই ভালো। আমি যেমন যেমন বলছি, তেমন তেমন খেলছে। এমন কী আতুপুতু স্পিনার পেয়ে ঠ্যাঙাবার আগেও আমাকে জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছে, ‘মার লু ইসে?’ তা এসব করেই চলছিল।

আমি আবার সিঙ্গলস মোডে চলে গেছি। বল স্যুইং হচ্ছে সকালের তাজা উইকেট। কায়দার দরকার নেই। ব্যাটে বলে কর গ্যাপে ফেল আর ছোট। ছোট মানে? বলি বয়সটা কত হল খেয়াল আছে? আর তার উপর অভ্যাসের দফারফা! যা হবার তাই হল, বারো ওভার ব্যাট করার পর আর দেখি হাতে পায়ে জোর পাচ্ছি না। লোপ্পা একটা হাফ ভলি মিড উইকেটের উপর দিয়ে তুলতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটটাই শুধু কাঁধে তুলেছি! লোপ্পা ক্যাচ দিয়ে বিদায়। আর টিমও তারপর ধসে পড়ল ১০৩ রানে। আমি সর্বাধিক ২১!

হাসবেন না! আসল গল্প তো এবারে শুরু হল। আগেই বলেছিলাম বোলাররা ঠিকঠাক বিশেষত, বাঁ হাতি পেসারটা শুরু করল ভিতরের দিকে বল আনা। ব্যাস দু দুটো উইকেট তুলে নিতে ঘাড়ে চেপে বসলাম। টমসন হাত ঘুরিয়ে তুলল দুটো। আমি বল করতে এলাম, ছ নম্বর ওভারে, যে ছেলেটা ব্যাট করছিল তাকে একটু আস্তে সামান্য স্পিন মেশানো বল দিয়ে সেট করলাম। তার মনে হল আমাকে মাঠের বাইরে ওড়ানো যাবে। আর যায় কোথায়! পরের বলটা ১১০ কিমি গতির আর্মার। ঘঁক করে ভিতরে ঢুকল আম্পায়ারের আঙুল তোলা ছাড়া কিচ্ছুটি করার ছিল না।
অবশ্য এখানেও কাজ করা আছে! শুরু থেকেই আম্পায়ারে সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছি। কোন ডিসিশন চ্যালেঞ্জ করলে বকাবকি করছি ছেলেদের, আর নিজেও করছি না।

আম্পায়ারকে গুরুত্ব দিলে সেও দেবে। মানব সম্পর্কের গল্প। এসব করে দেখি আট উইকেট চলে গেছে। আমার দুটো উইকেট। কিন্তু টানা চার নম্বর ওভার করতে গিয়ে আইঢাই অবস্থা। দম পাচ্ছি না। দুটো ওয়াইড করে ফেললাম। কিন্তু শেষ বলটায় সর্বশক্তি নিয়ে জায়গায় ফেলে আবার একটা আর্মার। ফিফটি ফিফটি ডিসিশন। কিন্তু ততক্ষণে আম্পায়ারের মনে এই বিশ্বাস জাগাতে পেরেছি যে ‘দিস ম্যান ক্যান ডু নো রঙ!’ অ্যাপিল করতেই ঢ্যাং করে আঙুল তুলে দিল। উফফফ শান্তি শান্তি!

শেষ উইকেট। চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কত রান!’ বলে আট রান বাকি! আমি বললাম, ওসব দরকার নেই কত রান হয়েছে বল!

এগুলো সব মানসিক খেলা। যদি বলেন আট রান করতে হবে আট ওভারে, সেটা লোকে করে দেবে। কিন্তু যদি বলেন ছিয়ানব্বই হয়েছে আর করতে হবে একশো চার। তাহলেই দেখবেন চাপের নাম বাপ, খাপে খাপ, পহলে আপ! আরে একশো করুক আগে তারপর কথা বলিস। ঠিক তাই। শেষ উইকেটে যখন পাঁচ রান বাকী শেষ ব্যাটসম্যান দাঁড়ালো টমসনের সামনে। আমি ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে চেঁচিয়ে বললাম, ‘উইকেট মে ডাল ইয়ে সামহাল নেহি পায়েগা!’ আর হলও তাই! নিরেনব্বুইটা পাখি তীরে উঠতে পারল না। চার রানে জিতে গেলাম।
আর তারপর বন্য উৎসব! (ওয়াইল্ড সেলিব্রেশনের বাংলা তো এটাই হবে নাকি?)

অফিসেও কেউ ভাবে নি প্রথম ম্যাচ জিতে ফিতে যাব। সে তো একদম হিরোজ ওয়েলকাম। মিষ্টি বিতরণ ইত্যাদি।
পরের ম্যাচ কোলকাতা থেকে ফিরে একত্রিশে অক্টোবর। এবার মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস মন্ত্রণালয়। এবারে অবশ্য প্রস্তুতি সামান্য বেশী। আগের দিন ডেসিগ্নেটেড থ্রোডাউন নিয়েছি। বল করেছি বেশ কিছুক্ষণ সারা মাঠ বার দুয়েক চক্কর লাগিয়েছি।
কিন্তু টসে জিতে আবার ব্যাটিং। আবার ওপেন! এবারে আমার সঙ্গে সেই মানব সম্পদের পুরনো সাথী। কোনরকমে ব্যাটে বলে করতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আমার সঙ্গে আছে আমার স্লেজিং। মেন্টাল ডিসইন্টিগ্রেশন। ভাল করে দেখলাম, বিপক্ষের বোলার বলতে পৌনে দুই! একটা বেশ ভাল বোলার আছে, যেটা বেশ গতিতে আউট স্যুইং করায়। আর একটা মোটামুটি। বাকিগুলো বেড়া ডিঙানোর ভেড়ার মতো নম্বর পুরো করতে খেলছে। কিন্তু আউইট স্যুইং বোলারটার একটা সমস্যা হয়েছে বোলিং স্পাইকস গেছে ভেঙে। ব্যাস আমায় পায় কে। শুরু থেকেই তার কানের কাছে ফুসুর ফুসুর করতে লাগলাম, ‘সামহালকে হাঁ জাম্পকে টাইম পে থোড়া দেখকে। প্যায়ের মে মোচ না আ যায়ে! মুঝে তুমহারে লিয়ে ডর লাগ রহা হ্যায়!’ ইত্যাদি। সে বেচারি বাঁহাতিকে বল করতে গিয়ে গুছিয়ে পায়ের উপর দিচ্ছে আর আমিও গুছিয়ে তাকে বাউণ্ডারির বাইরে ফেলছি। মাঝে সাঝে ওয়াইড এসব নিয়েই তেরো ওভারে একশো দশ করে ফেলেছি।
এর মধ্যেই অবশ্য প্রথম ওভারের একটা রিস্কি সিঙ্গলস নিতে গিয়ে ডানপায়ের হ্যামস্ট্রিঙ-এ টান ফেলে তাতে স্প্রে করিয়ে নিয়েছি। জল পানের বিরতিতে আমার আরেক সিনিয়র সহযোদ্ধা বলে গেল ‘মাত্র ছাপ্পান্ন রান দূর হ্যায় আপ সেঞ্চুরি সে!’ ব্যাস ব্যাটা সেটাই কাল হল। ছেচল্লিশ করে লোপ্পাই ফুল্টসে দিলাম ঘুরিয়ে! পুরো লেগ সাইডে একটাই শর্ট মিডউইকেট। সে ভয়ে মুখের সামনে হাত নিয়ে মুখ বাঁচাতে গিয়ে দেখল হাতের মধ্যেই বল আসছে আর ব্যাটা খপাৎ করে নিল লুফে। হাফ সেঞ্চুরিটা মাঠে ফেলে এলাম।

সে যাই হোক শেষ হল একশো চৌষট্টি রানে তিন উইকেটে। আমার সঙ্গীটি পঞ্চাশ করেই ফিরল। আর কুড়ি ওভারের খেলায় একশো চৌষট্টি অনেক। তবুও আমি সবাইকে বলে দিলাম যে, মাঠে রান বেরিয়ে যাচ্ছে বলে খুব চেঁচামেচি করব। বিপক্ষ ভাববে প্রচুর রান করছে কিন্তু পটাপট ওভারগুলো করে ফেলব, যতক্ষণে বুঝবে ততক্ষণে স্টিমার গোয়ালন্দ ছেড়ে চলে গেছে। খুব একটা সমস্যা হয় নি! আমি খুব ভালো বল করিনি! কিন্তু একটা আশি রানের পার্টনারশিপ ভাঙলাম একটু বেশি ফ্লাইট আর ওভারস্পিন ব্যবহার করে। আর তারপর আর কি! টমসন আবার চার উইকেট নিল। ওরা একশো বাইশে অলআউট শেষ ওভারে। আর তারপর ভয়ানক গাত্রদাহ।

হ্যামস্ট্রিংটা সেদিন রাত থেকেই জানান দিচ্ছিল। সেটা একটু কমতে এই কোমরে ব্যথা। রিকভারি টাইমই বেরিয়ে যাচ্ছে তিন চার দিন করে। আর এখন তো হোম, কমার্স আর ওয়াটার রিসোর্সের মত শক্ত ম্যাচগুলো বাকি। দেখা যাক। মন্দ তো লাগছে না! নেয়াপাতি ভুঁড়িটা একটু একটু করে কেটে পড়েছে। ব্যাটে বলে হওয়ার বা ব্যাটকে টার্ণ বা বাউন্সে বিট করার একটা স্বর্গীয় আনন্দ আছে! সেটাও জীবনে ফিরে এসেছে। দিন কয়েকের জন্য হলেও! আরে এসব ক্ষেত্রেই তো গুলজার ফুলজার লিখে গেছেন না, ‘ফির এক নয়ি জিন্দেগি জিলে তু! বস ঠিক সে শ্বাস লেলে তু!’ না না গুলজার নন! ফুলজারই বোধহয় এমনটা লিখেছেন! আমেন!

(১৭২)

এই যে আমরা যারা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে চল্লিশ ছুঁয়ে একটু থিতু হয়ে বসেছি। যারা চাঁদের পাহাড়ের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্পর্কে এতদিনে নিশ্চিত হয়ে পড়েছি। আমাদের একদিকে লাইফ বিগিন্স অ্যাট ফর্টির দুষ্টুমিভরা চোখ টেপাটেপি আর আরেক দিকে স্বপ্নভঙ্গের আশাবেদনার দোলনচাঁপার গন্ধবিধুরতা। এক প্রান্তে ষাট সত্তর আশির ফেলে আসা গ্রামাফোন, টেপ রেকর্ডার, ওয়াকম্যানের তার, বাক্সভর্তি টিভি, টেনিস বল, ব্যাট, টিটি র‍্যাকেট, কাঁটা কম্পাস, চাঁদা, টিনের স্যুটকেস, জলের বোতল আর সেফটিপিন দিয়ে আটকানো রুমাল- আবার অন্য দিকে, চাঁদ পেরিয়ে মঙ্গলের দিকে বাড়ানো হাতে, আইপ্যাড, আইফোন, মিতসুবিশি আর অটোমেশন ছোঁয়া নতুন স্বপ্নের বেচাকেনা।

এর মাঝেই কিছু কিছু জায়গায় কেমন যেন তাল মেলাতে দেরি হয়ে যায়। কখনও কখনও মানসচক্ষে ভেসে ওঠে শৈশবের বাসস্টপে দাঁড়ানো একটা লোক বা রান্না ঘরে তেলঘামে ভেজা একটি মহিলার ছবি। শৈশবে কারা যেন আমার পিছনে লাগত, “তোর বাবা ইডেনে চাকা চালায়!” আর আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতাম।

একটা ভদ্রলোক কিছু না করেই আমার জীবনধারা নির্মাণ করে দিয়েছে। মধ্যবিত্তের ইমানধরমকে একশো বছরের একটা পুরনো দোতলা বাড়িকে পেরিয়ে দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটের ব্র‍্যাকেটে এনে ফেলেছে। সাফল্যকে পা মাটিতে পুঁতে ক্রিজ কামড়ে খেলার হাতিয়ার আর ব্যর্থতাকে রবার্ট ব্রুসের গল্পের উপজীব্য করে তুলতে শিখিয়েছে। ময়দানের ঘাসের মধ্যেও শিরদাঁড়া খুঁজে পাবার মন্ত্র দিয়েছে। এমন মন্ত্র যে কুড়ি বছর আগে ময়দানের ভদ্রতম ক্রিকেটার অরুণ লালও বলতে বাধ্য হন, “The most gentle person in the circuit, please remember me with him.”

এই ভদ্রলোককে দিলীপ বেঙ্গসরকার আম্পায়ারস রেটিং-এ শূন্য দিয়েছিল কারণ তখনকার ভারত অধিনায়কের আবদার রাখেন নি বলে। তিনি মনোজ প্রভাকর আর কপিলদেবকে একসঙ্গে ডেকে ধমক দিয়ে খেলোয়াড়ি মানসিকতায় ক্রিকেট খেলতে বলেছিলেন। দেওধরের ফাইনালে আজ্জু মিয়াঁর কাছে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়ে মণিন্দর সিং এসেছিল যদি কোন টিপস পাওয়া যায়। তিনি আমাকে আবৃত্তি শিখিয়েছিলেন। একটা আগফা ক্লিক, একটা ইয়াশিকা দিয়ে পাঁচবছরেই ফ্রেমবন্দি করতে শিখিয়েছেন। জোড়াসাঁকো কলামন্দির জ্ঞান মঞ্চের ঠিকানা দিয়েছেন আর দিয়েছেন এক আসমান ভর্তি ভালোবাসা।

আর সেই মহিলা। আসলে সেরকমভাবে লিখতে গেলে কিচ্ছু পাব না জানেন! অন্ততঃ উপরের মত রেজিউমে তৈরি করা তো যাবেই না। কিন্তু সব কথা কি স্কোরবোর্ডে লেখা থাকে? স্বয়ং নেভিল কার্ডাস বলে গেছেন না? স্কোরবোর্ড তুলো আর নুনের বস্তাকে একই চোখে দেখে যে। আমার দেখার চোখ, আমার শোনার কান, আমার গলায় ডাক আর স্পর্শ বর্ণ রূপ গন্ধের দুনিয়াকে খুলে দিয়েছিলেন এই মহিলা। ক্লাস সিক্সের লার্নিং ইংলিশ পড়া একটা হাফপ্যাণ্টুলকে স্বচ্ছন্দে গ্যাস লাইটার ধরিয়ে ভাত করতে দেওয়ার ইতিহাসই তো ফিসফাস কিচেন গড়ে। ক্লাস এইটে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর ইংলিশ চা। অটুট পরিশ্রম, মগ্নতার ডাক, ব্যালেন্স অফ মাইন্ড আর সত্যবদ্ধ অভিমান। রক্তমাংসের বাইরে এসব নিয়েই মানুষ গড়ে ওঠে।

ভদ্রলোককে একটা টাচস্ক্রিণের মোবাইল দেওয়া হল। ব্যবহার করেন নি কোনদিন বলে, আড়ভাঙা এখনও হয় নি। এই যে ফোনে ফোনে শেখানো, এগুলোয় মনে পড়ে যায়, আমার মেয়েটা কেমন কথায় কথায় ‘কেন?’ ছুঁয়ে থাকে। ছেলেটা কান পাতলেই ফোনের স্ক্রিনের আড়ালেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। উচ্চতা তো এভাবেই বাড়ে। অথচ আমার পাঁচফুট এগারোয় যেদিন আমি ভদ্রলোককে ছুঁলাম, সেদিন থেকেই যেন নিজের ইতিহাসে ওই দুজনের জায়গা কোথায় কীভাবে দেব, তাই নিয়ে ‘কিন্তু কিন্তু’ ভাব।

ভদ্রমহিলা গান শিখছিলেন, মাঝে বছর পাঁচেক। আগেও শিখেছেন, কিন্তু আবার শিখছিলেন। পূর্বনির্ধারিত বুড়ো বয়সেই। কিন্তু কেমনভাবে যেন ২০১৩র বিয়োগান্তক দৃশ্যের পর সেসব চুকেবুকে গেল। এখন মেধাহীন বাংলা টিভির ধারাবাহিক চক্ষুনিবারণ। কিছু নেই, কি ঘটে কেন ঘটে কোন কথা নেই। কেটে যায় সময়। মাঝে সাঝে নাতি নাতনিরা ফোন করে। তাদের সঙ্গে আড়াইটে-সাড়ে তিনখানা কথা আর তারপরের সেই খাড়াবড়িথোড়ের জীবন। ভালো লাগে না আর। সময় পেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেওয়া। একটু গান, একটু সংস্কৃতির তাধিন তাক। কখনও যদি মুচকি হেসে জীবন তাকায় তাহলে তো মনটা বেঁচে যায় তবু।

দুদিন আগেই ভদ্রলোক জ্বরে পড়েছিলেন। কিন্তু করার মতো কোন জায়গায় তো ছিলাম না পাঠক/ পাঠিকা, আর তার উপরে আরও পাঁচ ছ কাঠি পেরিয়ে ফোন করে খবর নিতেও ভুলে গেছি প্রচণ্ড চাপে।

কষ্টগুলো কীভাবে পেরিয়ে যায় চোদ্দ শ চল্লিশ কিলোমিটার যেন। নিজের শহরে জায়গা নেবার মতো যোগ্যতা ছিল না বলে শিকড় গেড়েছি এত দূরে। কিন্তু ওদিকের শিকড় ক্রমে ক্রমে শুকোতে শুকোতে টান পড়ে যায় সেটুকু নিয়ে আগে হয়তো করতাম, কিন্তু এখনও একটা প্রশ্বাসও খরচ করি না। মনকে বুঝিয়ে নিয়েছি, বাপ এগিয়ে চলাই জীবন। নির্বিকার মুখ আর ভাবলেশহীন হৃদয় এই নিয়েই এক্কাদোক্কা খেলা চলেছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তিনী মানতে চান না! যদি নিয়ে আসা যেত! যদি নিয়ে আসা যায় এখানে? সত্যিই কি যায়? আট দশকের শিকড় কি এক টানেই উপড়ে ফেলা যায়? তখন জলও পাওয়া যাবে না কোথাও!

তবুও তাঁরা থেকে যান। নানান ছলে যখন মহেশ বারিক লেনের গাড়ি ঢুকতে না পারা সরু গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে দোতলা বাড়িটা এসে পড়ে, তখন দেখি এক ঋজু চেহারার ভদ্রলোক আর এক দৃশ্যতঃ স্থবির হয়ে যাওয়া কিন্তু মনের কোণে সবুজ রেখে নেওয়া ভদ্রমহিলা। আর এদের পিছন থেকে ছায়া হয়ে যাওয়া একটা ছফুটের অবয়বহীন অভিব্যক্তি অভিবাদন জানাচ্ছে। আর যাবার সময় যেন একটা অস্ফুট জিজ্ঞাসা রেখে যায়, ‘আবার আসবি তো?’। কতদিন একদিকে ঘাড় কাত করে উত্তর দিতে পারব ছাতা নিজেও বুঝে উঠতে পারি না।

বয়স তো হচ্ছে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বোধগুলো ভবিষ্যৎকে রূপান্তরিত করছে। বাঁধনগুলোকে ধরে রাখার হাতটাও আজ যেন বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।

নাহ! কীবোর্ভ ভিজে ওঠার আগেই লেখাটা শেষ করি। খালি একটা কথা, পাঠক/ পাঠিকারা! শিকলগুলোকে জুড়ে রাখতে ভুলবেন না! দেখবেন স্পর্শের মধ্য দিয়েই আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের ইতিহাস গাথা অমর হয়ে থাকবে। আমেন!

(১৭১)

প্রত্যেকবার লটবহর গুছিয়ে হড়বড় করে কোলকেতা যাই আর ফিরে আসি। এসে দেখি আসার সময় কিছু একটা অবশ্যই ফেলে এসেছি। চিরুনি, ব্রাশ, পেন, মায় পাঞ্জাবী টাঞ্জাবী শুদ্ধু। এভাবেই বোধহয় আমার শহরটাতে উত্তরাধিকার রেখে আসি! এখনও।

পাঞ্জাবী বলতে মনে পড়ল, গত মার্চ মাস থেকে বিশেষ কারণে অফিসে পাঞ্জাবী পাজামা পরিধান করা শুরু করেছিলাম, যা প্রথমে প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন বেশ একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট কাম আরাম কা মামলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কী দুর্গা পুজোর ষষ্ঠীর দিন আমি কপাল ঠুকে ধুতি পরেও চালিয়ে দিয়েছি। প্রথম দিকে যারা এসব নিয়ে টিটকিরি দিত, তাদের জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় পোশাকের ধুয়ো তুলে ধুয়ে দিতাম। আজকাল দেখছি তারাই আমার ভারতীয়ত্ব এবং ইণ্ডিয়াননেসের (দুটোই এক হয়ে গেল নাকি?) প্রশংসা করছে আর পাঞ্জাবীর ভ্যারাইটির তারিফের সেতুবন্ধন ঘটাচ্ছে।

আমাদের বর্তমানে যিনি বিভাগীয় দায়িত্বে আছেন তিনি আদতে সামাজিক ন্যায় বিভাগের সচিব। মহিলা নিজের ডিপার্টমেন্টে ইনফরমাল পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কিন্তু সেদিন এক রিভিউ মিটিং-এ দিব্যি কালো পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পরে তাঁর সামনেই প্রেজেন্টেশন দিয়ে চলে এলাম। ধ্যাতানি না খেয়েই। আর আমাকে পায় কে!

যাকগে যাক, আবার বাপু লাইনে ফিরে আসি। এবারের বার্ষিক শিকড় অন্বেষণ মাত্র দিন নয়েক হবার জন্য অনেক কিছু কাটছাঁট করতে হয়েছে। তবে, এর মধ্যেই একদিন বালি ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বালিতে আমি বেশ কয়েকবার গেছিই, আমার বাবার প্রায় ২৭ বছরের সহকর্মী কাম বন্ধুর বাড়ি ছিল বালিতে। সেই বন্ধু, যাঁরা একে অপরকে ২৭ বছর ধরে, ‘অতীন দা আপনি’, ‘মনু আপনি’ করে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর আজকাল তো নিজের পার্শ্ববর্তিনীকেও তুই মুই করে ফেলি!

তা সেই মনুকাকুর বাড়ি ছিল আদতে মোহন বাগানের আড্ডা। বালির চ্যাটার্জী বাড়ির নাম ৭০-৮০র দশকের মোহনবাগানের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেখানেই দেখা ৭০-র সুপারস্টার আর আশির নক্ষত্রদের।

এরপর বালির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী হল যখন আমি ৯৭তে পেজার সেলসে মোবিলিঙ্কে ঢুকলাম। সবে গ্র্যাজুয়েশনের পর পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট পড়ে মাস চারেক হুগলী জুটমিলে যাতায়াত করছি। সরকারী চাকুরীর পরীক্ষা দেওয়া প্রায় শেষ। এদিকে গার্লফ্রেণ্ডের বাড়ি থেকে চাপ আসছে বিয়ে করতে হবে। তা আমার মতো সাধারণ একটা ছেলেকে চাকরী কে দেবে? তাই এক অগাস্টে সব দ্বিধা দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে চলে গেলাম মোবিলিঙ্কের অফিসে। ইন্টারভিউ! সাক্ষাতকার! তা ডিঙিয়ে চাকরিও পেয়ে গেলাম ডিলার সেলস এক্সিকিউটিভের।

প্রথম দিনেই ডাইরেক্টর আর সেলস ম্যানেজারের চ্যালেঞ্জ। পেজার বেচে দেখাও। আর আমার তো তিন দিন আগে থেকেই ফিট করা খরিদ্দার। ভাইয়ের বন্ধুর কাকা! পেজার নেব বলছিলেন। তাকে দিন তিনেক আটকানো হয়েছে। আমি দেব বলে। ব্যাস, মঞ্চে উঠে ঠিকঠাক ডায়লগ বলতে দিতেই জুটে গেল চ্যালেঞ্জ বিজয়ীর পুরস্কার পার্কার পেন। তারপর আর কী! আটমাসের মধ্যেই শোঁ শোঁ উত্থান আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে ডিএসএ থেকে সোজা কোম্পানির পে রোলে। আর সেই সময় জুটল বালি আর উত্তরপাড়ার দুই ডিলার। উত্তরপাড়ার ডাক্তারবাবু (নাম বলব না) ভাঁওতাবাজ নাম্বার ওয়ান। তাঁর অধীনে রাখা ডিএসএগুলোকে মাইনে দিত না। কিন্তু বালির যে ছেলেটি ডিলার হল, তার সঙ্গে বেশ পটে গেল আমার। দোষ বলতে ছিল বহুত মিথ্যে কথা বলল। কিন্তু আমি আবার সেলিং-এর ক্ষেত্রে রেপুটেশনটাকেই মূলমন্ত্র মনে করি। গাপ্পি দিয়ে সেলিং বন্ধ, কিন্তু তারপরেও কর্পোরেট আর লোকাল মার্কেট ধরে মাস তিনেকের মধ্যেই আমরা টপ সেলার হয়ে গেলাম।

ছিলামও চার মাস একদম সকলের মাথার মণি হয়ে। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে সরকারী চাকরির ডাক এসে উপস্থিত। তাই বন্ধন ছিন্ন করতেই হল। তারপরেও কিন্তু বালির ছেলেটি আমার বিয়েতে এসেছিল। আর নিজে নেমন্তন্ন করে বাগদা চিংড়ি খাইয়েছিল। তা সেসব তো নিরেনব্বুইতেই তীরে উঠে গেছে।

এবারে যাওয়া হল এক পারিবারিক গ্রেটার নয়ডাবাসী বন্ধুর আমন্ত্রণে। কালীপুজো পর দিন। আকাশ মুখ ভার করে এসেছে। কিন্তু তার মধ্যেও গুছিয়ে নিয়ে পৌঁছে গেলাম ট্রেন চড়ে তারপর টোটো করে। আর তারপর তো এলাহি ব্যাপার। বাড়ির মহিলারা রান্না বান্না করে রাত তিনটেয় কালীপুজো শেষ করে বিশ্রামও পান নি। সকালের খেতে সবাই হাজির। আর খাওয়া বলে খাওয়া? চিংড়ি মাছ দিয়ে চচ্চড়ি, সিঙ্গি মাছ দিয়ে লাল শাক, পার্সে, বোয়াল আরও কত কী! এত খেলাম যে হজম করার জন্য ট্রেডমিল দরকার পড়ছিল। কিন্তু সে সব ছিল না বলে ভর দুপুরে ভঁসভঁসিয়ে ঘুমলাম।

আর বাড়িটার ব্যাপারই আলাদা। মাসীমার পায়ে ব্যথা বলে উঠে উঠে দরজা খুলতে পারেন না। তাই দরজা খোলাই থাকে আর লোকজন এসে, ‘কেমন আছেন কাকীমা?’ বলে কলাটা মুলোটা তুলে নিয়ে চলে যায়। বন্ধুর ভাই একবার মাসীমাকে ডেকে দেখায় ‘আরে মা, দেখো তোমার শাড়ি পরে ঘুরছে!’ মাসীমা নির্বিকার, ‘আর পরুক না! আমার তো অনেকই আছে!’ ঠাকুর দেবতারা বোধহয় এসব বাড়িতেই অধিষ্ঠান করেন।

সবই ভালো ছিল ঝামেলা বাধালো আকাশ। মুখ তো ভার ছিলই কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর ঝাঁপিয়ে ভিজতে চলে এলো। এক এক করে ট্রেনের সময় কেটে যাচ্ছে আর আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। কিন্তু প্রস্তুতি তো নেওয়া হয় নি। তাই সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরলাম কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু কিনতে আরে বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টি ধরে গেছে আর লোকজন ভ্যানকে ভ্যান কালী ঠাকুর নিয়ে ভাসানে চলেছে। যেন সরস্বতী পুজো। এ আমার নতুন অভিজ্ঞতা। পাঁড় কোলকাতার ছেলে আমি ইন্সটিটিউশনালাইজড কালীপুজো দুর্গাপুজো আর হোমোজেনাইজড লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিক পুজো দেখেছি। গণেশ পুজোর রমরমায় আমি ইতোমধ্যেই পাড়ি জমিয়েছি পাথুরে ল্যাণ্ডে। কিন্তু সাইকেল ভ্যানে হাজার হাজার হাজরা ইয়ে কালী বিসর্জন নতুন অভিজ্ঞতা তো বটেই। আর নতুন হল আকাশ ভর্তি আকাশ প্রদীপ। অকালবৃষ্টির হাওয়ায় ভর করে ফানুসদের হইহই করে ভেসে যাওয়া। এসব দেখতে দেখতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যে ফিরে যেতে হবে। বাড়ি। আর যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবার সেই টোটোয় টো টো করে স্টেশন আর স্টেশনের আবছায়া বেয়ে স্যাঁতস্যাঁতে সন্ধ্যে।

ট্রেন এল আর আধঘণ্টা ধরে দমদমে চারে ঢুকব না পাঁচে ঢুকব করে কাটিয়ে দিল আর রাত্রে চিরপরিচিত লর্ডসের চাইনিজ খেয়েই বাড়ি ফেরা। সময় হয়ে গেল কোলকাতাকে দৃষ্টির ওপারে করার।

মাঝে এদিক ওদিক, স্যান্টাজ ফ্যান্টাসিয়ায় ঝুপুপিসির মাটন আর বাঁশপোড়া মাটন দিয়ে সরুচাকলি আর সিফুড স্যালাড হলই। কিন্তু যাবার সময় হয়ে গেল।

আর হলই বা কোন দিন। ২২ অক্টোবর! পনেরো বছর আগে ঠিক এগারোটা চল্লিশে একটা পুঁটলিকে বাম কোলে ধরেছিলাম। চল্লিশ সপ্তাহ ভিতরে থাকার পর নখ চুল নিয়ে তার সমগ্র বিরক্তি জানান দিচ্ছিল সে। আর আজ পনেরো বছর পরে ঝড়ঝাপটার সফর পেরিয়ে বয়সপ্রাপ্তির দোরগোড়ায় হাজির। এত বছরে প্রথমবারের জন্য জন্মভূমিতে ফিরে গেছিল দাদু ঠাকুমার সান্যিধ্যে। তাই আদর মেখে আসতে গিয়ে দেরী হল একটু।

কিন্তু চিন্তাটা আগের দিন রাত থেকেই নাড়া দিচ্ছিল। বাড়ির চাবিটা যেন পার্শ্ববর্তিনীকে বলেছিলাম আমার ব্যাগে রাখতে। কিন্তু আমি এবং পার্শ্ববর্তিনী উভয়েই আগাপাশতলা ব্যাগ খুঁজেও পেলাম না কিছু। সারা ফ্লাইটেও চিন্তা ছিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে কী ভাবে বারান্দায় নামব। তাও একটা বারান্দায় তালা লাগানো ছিল না। সেই বারান্দায়! উবার করে অফিস। অফিসেই রাখা ছিল আমাদের নীল রঙের নব বাহন। এতক্ষণ ধরে আশার বিপরীতেও বাজি ধরে আসছিলাম যে গাড়িতেই বোধহয় আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জুটল লবডঙ্কা। গাড়ি ঘুরিয়ে বারাপুল্লায় চড়ায় সময় মোটামুটি প্রস্তুত। উপরের ফ্ল্যাট থেকেই নামাটা সমীচীন হবে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে কার্ণিস ছুঁয়ে একটু বেশিই ঝুঁকি বটে। চাদরও আছে ব্যাগে তাই চিন্তা নেই। আর অন্যদিকে পার্শ্ববর্তিনী মনে মনে নুনের প্যাকেট মানত করছিলেন যদি পাওয়া যায়। আর কি সাংঘাতিক রিগ্রেসিভ কাণ্ড। যার জন্মদিন সেই ব্যাটা পড়াং করে আমার ব্যাগের ভিতর হাত দিয়েই বার করে আনল আরেকটি কাপড়ের ব্যাগ। যার মধ্যে মিটিমিটি হাসছে চাবিসোনাটি। আর পুঁটলি দিদিমণি তখনও তাঁর প্রশ্নের ঝাঁপি ঝাড়পোঁছ করছেন- ‘কেন?’ ‘দাদা চেঁচাল কেন?’ ‘তোমরা চ্যাঁচালে কেন?’
আরে জানিস না? ‘এ ফর বল’ বলে!

তারপর? তারপর আর কী? পরদিন সকাল থেকেই আবার হাঁটু ডোবা যমুনা বেয়ে জীবন জোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়া। আর থোড় দিয়ে বড়ি আর শাকের তরকারি রন্ধ্রণ। এভাবেই চলতে থাক জীবন। সময় আর দূরত্বকে পেরিয়ে। চরৈবেতি!

(১৭০)

বেশী সময় নেই বুইলেন। সদ্য সদ্য কোল্কেতায় এসে পৌঁছেছি, আর এখনই যদি আপনাদের সঙ্গে পিরিত করি তাহলে আমার প্রথম প্রেমিকাই রাগ করবে। সে যাই হোক এয়ার ইণ্ডিয়া আজকাল মানুষজনকে পাক্কা নিমাই সন্নেসী বানাবার ধান্ধা করছে। এমনিতেই কস্টকাটিং-এর চক্করে এয়ার ইণ্ডিয়ার ইস বার শনিবার আব কী বার মঙ্গলবার।

তা গতবারে কোলকাতা আসতে গিয়ে বললাম তো ঘুমের ঘোরে ‘জৈন মিল’ খাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল ঘুঘনি আর পরোটা। আর নর্মাল মিল দিয়েছিল ক্যারামের স্ট্রাইকারের সাইজের ইডলি আর মাকড়ির সাইজের বড়া। যে কোন সুস্থ পেটের এবং মস্তিষ্কের মানুষ পরেরটা ছেড়ে আগেরটাই খাবে। আমিও নিজেকে সুস্থ বলেই দাবী করে থাকি! অতএব এবারেও আসার সময় আগ বাড়িয়ে আমি ‘জৈন মিল’ খাব বললাম আর এবারে আমার বাক্স প্যাঁটরারা নর্মাল ভেজ মিলই নিল।

কিন্তু এবারে তো মিলে সুর মেরা তুমহারা হয়ে গেছে। তিন দিন আগেই আমি ময়ূর বিহারের মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে পাঁচ মশলার ফুচকা খেয়েছি। জিরের জল, ধনেপাতার জল, হিংএর জল, পুদিনার জল আর কেওড়ার জল। নাকের জল চোখের জল না ফেলেই বলছি হিং আর কেওড়াটা আমার মেফিস্টোফিলিস লেগেছিল। এই রে কর্ড লাইন ধরে ফেলেছি!

তা যা বলছিলাম! আমার জৈন মিল খুলতে দেখি ইক্কিরে বাওয়া! এখানে বিয়ের আংটির সাইজের বড়া আর ধনে পাতা দেওয়া পাঁচ সিকের সাইজের সাদা রঙের একটা কিছু যাকে ইডলি বা পরোটা বলতে মন সরে না। সঙ্গে অবশ্য একটা জাঁদরেল লাল লঙ্কা দেওয়া সাম্বারও দিয়েছিল। আর কেলো টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি কেসে দেখি বাক্স প্যাঁটরারা ঘুঘনি পরোটা প্লেটে নিয়ে আমার দিকে মুচকি হেসে চোখ নাচাচ্ছে।

সে যাই হোক সেসব খেয়ে আমার অপাপবিদ্ধ পেটে জেলুসিল গোঁজার অবস্থা হয়েছে। কিন্তু একটা কথা বলতেই হচ্ছে! নেহাত পার্শ্ববর্তিনী সক্কালবেলায় পনেরো মিনিট পরে সবার ঘুম ভাঙা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্য তৎপরতায় একটা জবরদস্ত চিজ অমলেট খাইয়ে বাড়ি থেকে বার করেছিল তাই আজ টিকে আছি। কিন্তু তিন দিনের বাসী বড়া আর আধকাঁচা ইডলির মতো কিছুটা এখনও পেটে গজগজ করে যাচ্ছে। যাই হোক, কোলকাতা আমার দুঃখ ভুলিয়ে দেয়, এবারও দেবে বলে আশা রাখছি। আর সেই সব বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আবার দেখা হবে জেনেই পুলক লাগছে, যা পুদিনহরার মতো গলা ছুঁয়ে বুক পেটে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আজ তাহলে এ পর্যন্তই!

প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ সকালে তিনটেয় একটা অ্যালার্ম মেরেছিলাম নিজের মোবাইলে আর ব্যাকআপ হিসেবে পার্শ্ববর্তিনীর মোবাইলে তিনটে দশ-এ! আবিষ্কার করলাম যে তিনটে দশের অ্যালার্মটা এখন বাজছে। ভর বিকেলে কোলকাতার বুকে, শান সে! না আসার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলাম। কিন্তু কেমন করে জানি না আমার বাক্স প্যাঁটরাদের উৎসাহে এসে পড়েছি বটেক।

(১৬৮)

২০১৪র পরে আর ফিসফাস বই হিসাবে বেরোয় নি। এবারে করলে বইটার কভারের রঙ কালো বা ধূসর রাখব ভাবছি। না মানে শুরুতেই এমন কথা কেন? কে জানে কেন? বুঝতে পারি না! খালি আকাশে বাতাসে ঘাসে ঘাসে দেখি রঙগুলো বদলাচ্ছে। সমানে সমানে বদলাচ্ছে। পথে ঘাটে দূষণেরা ফুসফুস ছেড়ে হৃদয়ে দানা বাঁধছে। আর একটা অদ্ভুত ধরণের ইমোশন (সরি আবেগটা বড়ই কাঁচা লাগছিল ইমোশনের কাছে!) গলার কাছে দানা বাঁধছে।

মনের ভাবটা স্পষ্টভাবে বলে উঠতে পারছি না। মানে এটা ঠিক ভয় লাগা নয়। ভয়টা বরং চলে যাচ্ছে। এটা বিচ্ছিরি লাগাও না। বিচ্ছিরি লাগা এর কাছে কিছুই না। অথবা রাগ ঘৃণা বিদ্বেষ এই শব্দগুলোও ঠিক বসাতে পারছি না। কারণ এই যে ইয়ে লাগা সেটা তো এগুলোকে নিয়েই। রাগ ঘৃণা বিদ্বেষ।

কোথাও কোথাও একেই যেন পুরুষত্ব বা বীরত্বের প্রতীক বলে বোঝানো হয়। বুক দাপিয়ে চিৎকার করে বিজয়ীর উল্লাস। যেন রোনাল্ডো গোল করেছে!

এক এক করে বলে দেখি। আপনারা কী বলেন!

ভাদ্র মাস একটা বিশেষ মাস যা নিয়ে চারপায়ের প্রাণীদের খিল্লির শেষ নেই। তেমনই শ্রাবণ মাস হল ভক্তির মাস। শারদোৎসবে যেগুলো হয় সেগুলোকে ভক্তি দিয়ে মাপা যায় না। হৃদয় দিয়ে মাপতে হয়। কিন্তু শ্রাবণে শৈব উপাসকরা ভক্তিরসে ভগবানকে সিঞ্চিত করেন। আমাদের ছিল তারকেশ্বর আর এখানে হরিদ্বার।

না সেসব নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মেঘটা জমতে শুরু করেছে গত কয়েক বছর ধরে। যখন থেকে এই কাহার কাঁধে কাঁওয়াড়িদের জন্য সুযোগসন্ধানীরা এই একান্ত ব্যক্তিগত যাত্রাকে সাংগঠনিক করে দিয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বড় বড় কাটআউটে ঝোপে ঝাড়ে গজানো রাজনৈতিক সুবিদাবাদীদের অভিবাদন জানানো ব্যানার। দেবেন্দ্র দেড়া থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কেউ বাকী নেই। কাঁওয়াড়িদের জল পান করানো জন্য গগন বিদারী মিউজিক সিস্টেমে হানি শিঙের চরণে সেবা লাগির রিমিক্স সমেত বড় বড় শামিয়ানা। আর কার্যবিহীন স্বেচ্ছাসেবকদের দল। যারা মনের সুখে মাদক সেবন করে (শিবের চ্যালা! কিচ্ছু বলার নেই!) উত্তুঙ্গ উচ্ছ্বাসে হর হর মহাদেব ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ছেয়ে দিয়েছে। আর ইদানীং আবার নতুন ট্রেণ্ড। জাতীয় পতাকা হাত মোছার কাপড়ের মতো যত্র তত্র লাগানো। যেন দেশাত্মবোধ দেখালেই সাত খুন মাফ।

তে এরকমই এক সকালে দেখি একটা নেশায় চুরচুর বিরোধী সমাজের লাগামহীন ষাঁড় হাতে লাঠি নিয়ে গাড়ি শাসনে লেগে পড়েছে। আমার এই গাড়িটা বিদায়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই ভাই যাবার পর থেকেই ইমোশন ফিমোশন একটু কম। অন্ততঃ বিয়োগ ব্যথা গুণিতক হয়ে পার্শ্বচর হয় না। কিন্তু লাঠির বাড়ি মারলে তো কথা নেই কোন।

তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, পাড়ার মধ্যেই সাইকেল নিয়ে যাবার সময় ‘লুচি’ গুণ্ডার চটির পিছনের ভাগ মাড়িয়ে দিই। বাছাবাছা বিশেষণ চড়চাপড় সব হজম করে নিয়েছিলাম ‘বাপের সম্মান’ রক্ষার্থে। (এই বাপের সম্মান কেসটা বহুত গোলমেলে কেস। আপনার ঘেঁটি ধরে একটা তালপাতার সেপাই ক্রমাগত নেড়ে দিয়ে সুভাষিতাবলী ঝেড়ে যাচ্ছে আর আপনি কিসসু করতে পারবেন না!) কিন্তু যেই ব্যাটা ‘শালা আজ সাইকেলই ভেঙে ফেলব’ সাইকেলে হাত দিয়েছে। কোনা মেরে বাঁহাতের দুটো আপার কাট চোখের কোল ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেই জোশ আজ আর নেই, তোরঙ্গে বাঁধা। কিন্তু গাড়িতে হাত দিলেই কী থেকে কী হয়ে যেতে পারত সে আর বলতে পারব না। কপাল ভাল (কার কে জানে?) আমি অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি আস্তে চালিয়ে, ছেলেটার গা ঘেঁসে চালিয়েও তার লাঠির প্রসাদ থেকে বঞ্চিত থেকে গেলাম। না হলে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়ার একটা অভিজ্ঞতা থেকে যেত। হয়তো গণ ধোলাইয়েরও।

তা সে সব থাক। দিন পনেরো সবাইকে ভক্তিতে ভাসিয়ে শ্রাবণ মাস বিদায় নিল ভাদ্রের শেষ এসে হাজির। সেদিন গাড়ি না থাকায় উবারের সাহায্য নিয়েছি, দশ মিনিটের রাস্তা যেতে দশ ঘন্টা লাগছে, ড্রাইভার বলল, ‘ম্যায় পচ্চিশ সাল সে দিল্লি মে হুঁ। বাই গড কভভি ইত্নে সারে গণেশজীকে ভক্ত নেহি দেখা।’

আর ট্রেণ্ডটাও এক। মাথায় একটা রঙ না জানা ফেট্টি, পেটে মাল, মুখে আবির, চোখে রঙ আর ঠোঁটে রাজ্যের নৈরাজ্যের প্রদর্শনী। আর অবশ্যই বক্স বাজছে। যার যত বেশী বক্স তার তত বেশী দর। গানের কথা কিসসু বুঝতে পারবেন না, খালি গুম গুম আওয়াজে গাড়ির উইণ্ডস্ক্রিন থেকে আত্মারাম সবাই খাঁচা ছেড়ে পালাবার কথা ভাবছে। যত্র তত্র মূত্র ত্যাগ আর জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে বিজয়োল্লাস। ঠিক যে ভাবে আপনার কাজের মাসি ঝুল ঝাড়ু দিয়ে ঘরের কোণের কালো কালো ঝুল সরিয়ে সাফ করেন। ঠিক সেভাবেই এরা দেশভক্তিকে প্রশ্নকারী সুস্থশরীরগুলোকে সাফ করে দিয়ে ব্যস্ত করে ফেলবে।

আর সবাই সেই হ্যামলিনের ইঁদুর। নেতাজি কাল লাল কিলা থেকে আপনাকে ডোকলাম দেখাচ্ছে তো আপনিও অবিশ্বাসীদের বৃন্দাবন দেখাতে রেডি। আর দরকার পড়লে অন্ধকারও। সত্যিই যেন অন্ধকার যুগে এসে পড়লাম। যেখানে বিরোধাভাস মাত্রেই কার্গিলের ঠাণ্ডার চিন্তা জাগিয়ে দেওয়া গরম গরম বুলি আর সে সব ডিঙিয়ে গেলে চাপাতির কোপ বা বন্দুকের নল। আমাদের অবস্থা হচ্ছে সেইসব পতিব্রতা স্ত্রীয়ের মতো, যারা মার খেয়ে মরে গেলেও সিকিউরিটি হারাবার ভয়ে আপাত মানব পরিচয়বহির্ভুত সেই সব রাক্ষসদের বিরুদ্ধে একটাও কথা বলে না। ঠাণ্ডা ঘর ল্যাপটপ স্মার্টফোন আর নিয়ন্ত্রিত জীবন চৌহদ্দি পেরিয়ে একসঙ্গে বিরোধ করা কি চাড্ডিখানি কথা। (দেখবেন এরপর কমি ছাগু তিনো নিয়েও গাল শুনব।)

আসল কথা হল ফাঁপা ঢোল বাজে বেশী। আর আমাদের দেশটা হয়ে উঠছে সে রকমই। আমরা মায়ানমার যাব বলে পরিকল্পিত ভাবে ঘরহীন মানুষগুলোকে দেশছাড়া করে দিতে ছাড়ি না। গাজা ভুলে গিয়ে নেতানেইয়াহুর সঙ্গে ছবি তুলে ফেলি আর আপামর অশ্বেতকায়ের সর্বনাশ মাথায় তুলে ট্রাম্প কার্ড খেলে বসে থাকি কেকেকেকিরণ! (ক্লু ক্লুক্স ক্লান আর কি!)
এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু স্বপ্ন দেখতে শখ জাগে জানেন? স্বপ্ন দেখি ধর্ম বলতে মানুষ চিনবে মানুষ শুধু। সালমা খাতুন বা জাভেদ হাবিব তাদের ধর্মের কলাম নিয়ে আমাদের কাছে পরিচিত হবেন না। শুধু মানুষ হিসেবেই যেন পরিচিত হয়ে যাই। সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুকে একটা ডায়লগ ছিল অর্গানাইজড রিলিজিয়ন মানুষ মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। আর কত বিভেদ বা ফারাক হবে? উপরওলা তো ইতিমধ্যেই, কালো সাদা বাদামী, পুরুষ মহিলা, গুঁফো মাকুন্দ, হিস্প্যানিক এশীয়, লম্বু মোটু এসব ফারাকগুলো দিয়েই পাঠিয়েছেন। কিন্তু সে তো স্বাতন্ত্র্যের খাতিরে। দল পাকিয়ে পাঞ্জা লড়ার জন্য তো নয় সে সব।

মানুষ সবথেকে দুর্বল প্রাণী হয়েও মানবতা আর মানবিকতা দিয়েই তো আজ শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছে। তাহলে আর আলাদা করে আমরাই সেই চামড়া গুটিয়ে নিয়ে অপরের চামড়া গুটিয়ে দিতে তৎপর হয়ে পড়ছি কেন? মানুষ মরে। যে একবার জন্ম নিয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে অবশ্যম্ভাবী থেকে অমোঘাবস্থায় নিয়ে যাচ্ছি কেন? আসুন না। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নাস্তিক আস্তিক ধনী গরিব সাদা কালো সবাই মিলে পৃথিবীটাকে আরেকবার সবুজ করে তুলি। শুধু গাছ পুঁতেই তো নয়। মানুষের মনটাকে হৃদয়টাকে সবুজ করে তুলতে হবে। কষ্টকর পথ, ধান্দাবাজীর জায়গা নেই, শর্টকাট নেই, মস্তিস্কহীনতা, বিবেকহীনতা, হৃদয়হীনতার জায়গা নেই। যে যতটুকু পেয়েছি তাই নিয়েই সবার কথা ভেবেই কাজ করতে শুরু করি। বাংলায় যাকে বলে হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ। তাহলে হয়তো আপনার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটাও বাঁচতে পারে। নয়তো কে জানে, সময় কোথায় আমাদের জন্য চাপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। কল্লা আমাদেরও নামতে পারে ভাই! তাই না?

প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ এই লেখাটা নিয়ে আমরা ওরা করবেন না প্লিজ। সব ধর্মেই কম বেশী নাশকতা রয়েছে। নাহলে বৌদ্ধ ধর্ম বলতে যে অহিংসা বুঝি তারা রোহিঙ্গাদের কেটে পিস পিস করে ফেলতে পারে? রোহিঙ্গাদের জন্য, আশ্রয়হীন মানুষগুলোর জন্য একটু ভাবুন। আপনার দরজা খুলে দিতে হবে না। কিন্তু সামগ্রিক দরজাটা যেন খুলে যায়। আলোচনারও।

প্র পু ১ – নাহ লেখাটা শুরু করার সময় মনটা যে রকম ধূসর ছিল এখন কেমন যেন নীল নীল হতে শুরু করেছে। আকাশের মতো বিস্তৃত নীল। এবারে ফিসফাসের রঙটা নীলই হোক কেমন?

(১৬৭)


আমি ভিক্ষা দিই না। কোন স্পষ্ট লজিক নেই। কিন্তু দিই না। হয়তো মানুষকে কর্মক্ষম দেখতে ভালো লাগে বা অভ্যাস খারাপ করতে দিতে চাই না ইত্যাদি কিছু হবে। অথবা এই যে রাজধানীর রেডলাইটে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে কিছু দেহাতি মহিলা ঘোরাঘুরি করে তারা মাদারি নাকি অন্য কিছু? কয়েকটা বাচ্চা সং সেজে ডিগবাজী কলাবাজী দেখায় আর চুলে লম্বা বিনুনি বেঁধে টাঁই টাঁই করে ঘোরাতে থাকে। বা কয়েকটা বাচ্চা একটা নোংরা কাপড় নিয়ে এসে গাড়ির এখানে ওখানে একটু মুছে দেয়। এরা কারা? কোথা থেকে আসে? শহরবাসী আমরা শুধু সন্দেহ নিয়েই তাকিয়ে থাকি। আর দেখি যে রাজধানীর ক্রমবর্ধমান ফ্লাইওভারগুলি ঠিক নিচে, কাঠের চুল্লি আর পোড়া হাঁড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে সংসার পেতেছে। দশ ফুট বাই দশ ফুটের গণ্ডিটাও তাদের জন্য নেই।

সন্ধ্যা হলেই সন্দেহ বেড়ে যায়। দেহব্যবসা অথবা রাহাজানি। সন্দেহের তীর এদিকেই ঘুরতে থাকে। মাথায় জট, চোখে পিচুটি আর নাকে পোঁটাওলা শৈশবের পরেই এসে হাজির হয় অপুষ্টির যৌবন বা অপক্ক বার্ধক্য। আকাশের দিকে তীর ছুঁড়ে দিয়ে, পৃথিবীর বুকে রুক্ষ পদক্ষেপ ফেলে জীবন কেটে যায়। আদমসুমারি আর আচ্ছে দিন, সরকারি সাহায্য আর গরিবী হটাওয়ের ইমেজে এরা বড় বড় ছোপ। পুলিশ আর সমাজবিরোধীদের সঙ্গে নিত্য হিসেবে নিত্য যাপন। এরাই হল সেই সব মুখ যাদেরকে লুকিয়ে রেখে আমরা আধুনিক ভারতের ছবি তুলে ধরছি বিশ্বপিতার কাছে।

সে যাই হোক, সেই সব লজ্জাই হোক আর নিজেকে মুক্ত পৃথিবীর প্রতিভূ হিসাবে দেখার অভ্যাস থেকেই হোক। আমি ভিক্ষা দিই না। শুধু যখন কোন বয়স্ক লোককে দেখে মনটা উদ্বেল হয়ে ওঠে যাদের সত্যিই হয়তো করার কিছু নেই, সেখানে হাতটা আপনিই পকেটের দিকে চলে যায়। আর নিজের অপারগম্যতায় মাথা নিচু হতে থাকে।

কদিন আগে রবিবার, আইটিও থেকে মানদই হাউসের দিকে গাড়ি ঘোরাবার আগেই দেখলাম এক আপাত অন্তঃসত্ত্বাকে। সেই দেহাতি রূপ আর তার সঙ্গে আরও জনা চারেক কম বেশী বয়সের মহিলা। এরা হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য সাহায্য চাইছে। কিন্তু আমরা শহুরেরা এখন অভিজ্ঞ হয়ে গেছি। সব জানি এর পিছনের গল্প। কিছুদূর নিয়ে গিয়ে যা নয় তাই হয়ে যেতে পারে। পেটের থেকে বেরিয়ে পড়তে পারে পিস্তল অথবা অন্য কোন প্রাণহানি অস্ত্র।

কিন্তু মজার ব্যাপারটা হল, গাড়িটা ঘুরতেই দেখি একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে, লালবাতি টপকানোদের জন্য টোপ ফেলে বসে আছে। গল্পটা কেমন যেন ইয়ে লাগল! মানে মেয়েটি যদি সত্যিই অন্তঃসত্ত্বা হয়, তাহলে তো তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো উচিত। আর না হলে শ্রীঘরে।

তাড়া ছিল কিন্তু তাও গাড়িটা থামিয়ে মুখ বার করলাম। দিল্লিতে পুলুশ এসব ব্যাপারে খুব হেল্পফুল। জানে কি জানে না কিন্তু ঠিক দিক দেখিয়ে দিতে ছাড়ে না। বললাম ব্যাপারটা- ব্যাস যেন চোর ধরা পড়েছে এমন মুখ করে বিগলিত হাসি দিয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা দেখতা হুঁ!” যেন আকাশ থেকে বিষ্ণু দেবতা বরাভয় মূর্তি নিয়ে বিশ্বরূপ দর্শন দিচ্ছেন। কিন্তু ঐ যে বললাম ট্যাম। ট্যামই নেহি থা না! তাই নাগরিক কর্তব্যকে নীলটুপিধারীর হাতে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চললাম পিছনের দিকে না তাকিয়ে। জানি একবার বলায় কিছু হবে না, আর বারবার বলায় হয় তো সেদিনের জন্য ভাত মারা যাবে চৌর্যোপজীবিনীদের।

তবে সব গল্পগুলো ঘেঁটেঘুঁটে গেল কালকে। মানে আমি নিজে আত্মপ্রচারকে খুব একটা পছন্দ না করলেও, এই রোগটা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নই। কোথায় কখন যেন কোন সূক্ষ্ম গণ্ডিটা পেরিয়ে চলে যাই আর রাবণ রূপ ধারণ করে ফেলি, তার হিসাব রাখতে পারি না। তবুও বলছি জানেন।
কাল রাতে পার্শ্ববর্তিনী আর মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। ফর আ চেঞ্জ মেয়েটা আমার পাশের সিটে বসে। সামনেই লালবাতি আর লালবাতি পেরোলেই গাজীয়াবাদে ঢুকব। সামনে একটা এসইউভি। আর আমরা এদিক ওদিক হাবিজাবি বকে যাচ্ছি। যদি করবী ফুলগুলো টুপ করে গাছ থেকে পড়ত গাড়ির জানলার কাঁচ বেয়ে তাহলে রাতের বেলা ফুল পাড়ার কষ্ট থাকত না আর লাল গোলাপি ফুলগুলোও মেয়ের কানে ঠাঁই পেতো! এই সব।

তাকিয়ে দেখলাম লাল বাতির কাছেই দুটি বাচ্চা মেয়ে বেলুন বেচছে। হঠাৎ লাল আলো সবুজ হল আর দেখলাম আমার সামনে দাঁড়ানো গাড়িটা যেটা এগিয়ে গিয়ে গাজীয়াবাদে ঢুকবে তার ড্রাইভারটা হাত বাড়িয়ে যেটি দুটির মধ্যে ছোট সেই মেয়েটির হাত থেকে একটা বেলুন ছিনিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল গন্তব্যের দিকে।

পাঠক/ পাঠিকারা, আমরা তো মানুষ। সবার আগে মানুষ। চকচকে গাড়ি আর ঝকঝকে পোশাকের মোড়ক পেরিয়ে আমরা মানুষ। সামান্য সুকুমারবৃত্তিগুলো কি ষড়রিপুর অধীনে ফেলে রেখে দাঁত নখ বার করে ফেলতে পারি? মনুষ্যত্বের লেশ নিয়ে দুপায়ে হেঁটে যাবার সময় ‘আরে এ তো সামান্য ব্যাপার!’ এই কথাটা না বলে একটু মন নিয়ে ভাবতে পারব না? দাঁত নখ? তোমার মন নাই মানুষ?

হতবাক অবস্থার মধ্যেও এগিয়ে গেলাম গাড়িটা নিয়ে। হাপুস নয়নে কাঁদছে মেয়েটা। কাশছেও। তার দিদি তাকে বুকে জড়িয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে আর মাই বোধহয়, কোথা থেকে ছুটে এসেছে। মেয়ের কান্না থামেও না। পাঠক/ পাঠিকারা, আমরা সামান্য মানুষ! সারা পৃথিবীর সকলের দায়ভার নিই নি। কিন্তু ওই মুহুর্তে যেটা করতে পারলাম সেটা হল, বেলুনের দাম জিজ্ঞাসা করে দুটো দশটাকার নোট ধরালাম। একটা বেলুন নিজের মেয়ের হাতে দিলাম আর আরেকটা সেই অমানুষটার হয়ে ক্ষমা চেয়ে। মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওই দিদিটা বেলুন দিল? দিল হয় তো! হয়তো সমগ্র মানব জাতির পক্ষ থেকে একটা অক্ষম চেষ্টা মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রাখার।

মাঝে মাঝে মনে হয় ফিসফাসটা ফিসফাস না হয়ে নিজের ঢাক নাম দিলেই হতো। এ তো শুধুমাত্র নিজের কথা বলা। এই করেছি সেই করেছি। বা হয় তো নিজেকে আয়নায় দেখা অথবা আপনাদের নিক্তিতে নিজেকে মেপে নেওয়া। সে যা হোক। মুখ্য হল মানুষ হওয়া। সবরকমভাবে তো হয়ে ওঠা হয় না। এই যেমন মোড় ঘুরে গাজীয়াবাদে ঢুকে যখন দেখলাম দুটো ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আর তার কিছু দূরে সেই অলপ্পেয়ে এসইউভি। বিশ্বাস করুন হিরো হবার ইচ্ছে থাকলেও নেমে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারি নি তাদের। ঝামেলায় জড়াতে চাই নি বলেই। কিন্তু পার্শ্ববর্তিনী বা আমি কেউই হয়তো বাচ্চাটার কান্নাটা ভুলতে পারি নি। বেলুনটা বাড়িতে খেলতে খেলতে ফেটে গেল আধ ঘন্টার মধ্যেই। কিন্তু তাও বোধহয় অমানুষদের বুদবুদ ফাটল না। ক্ষণিকের মস্তিষ্কহীন ছ্যাবলামোই হয়ে রয়ে গেল মনুষ্যত্বের আলো আঁধারি ঘিরে।

আর আমাকেও ভাবতে বাধ্য করল সময়, ওই কিচ্ছু না পাওয়া লোকগুলোর কথা। যারা পুলিশের লাঠি আর সমাজবিরোধীদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকে পরের দিনের সূর্যটাকে দেখার আশায়। সেটাও ঠিক করে দেখতে পায় কি না কে জানে?