আমার মামারবাড়ি ছিল তেলিপাড়ায়। ছিল বলছি কারণ বর্তমানে সেখানে কেউ থাকে না। বড়মামা সল্টলেকে থাকেন। তবে তিনি দেশে ফেরার পর থেকে তাঁর সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তার আগে?তার আগে বলতে পারব না, কিন্তু ফিসফাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে মামাদের সঙ্গে আমার একটা বেশ অম্লমধুর সম্পর্ক আছে।
ও হো, এ মামা সে মামা নয়। এ হল ইউনিভার্সাল মামা, চোস্ত ইংরাজিতে যাকে বলে সর্বজনীন মামা।
মামার গল্প ফিসফাস ভর্তি, তবে একটা করার লোভ সামলাতে পারছি না। কনট প্লেসের আউটার সার্কেল আর ইনার সার্কেলের মাঝে একটা সিনেমা হল আছে ওডিওন। পুরনো, সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা। তা তার সামনে একটা পার্কিং রয়েছে।
তখন স্কুটার চালাতাম, দিল্লির কনট প্লেসে যাঁরা এসেছেন তাঁরা জানেন যে কনট প্লেসের ইনার, মিডল আর আউটার সার্কেল ওয়ান ওয়ে। অবশ্য ইনার আর আউটার ক্লক ওয়াইজ আর মিডল অ্যান্টি। তা বাইরে দিয়ে এসে মিন্টো রোডের সামনে যে কাটটা ভিতরে গেছে সেখানেই সেই পার্কিং, আউটার সার্কেল থেকে মাত্র দশ কদম। কিন্তু এখানে পার্ক করতে গেলে আপনাকে পুরো চক্কর লাগিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার ঘুরে এসে করতে হবে।
তা দিনটা ছিল ১৯শে নভেম্বর। সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। অবশ্য দিল্লির জাঠ পুলিশ সলিল চৌধুরীকে কি চিনবে? তার থেকে ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন বলেই চালাই। তা সেদিনই হঠাৎ মাথার ক্যাড়া নড়ে উঠল এবং আমি আউটার সার্কল দিয়ে ঘুরে পুক করে রঙ সাইডে ঘুরিয়ে পার্ক করে সিনেমা দেখতে ঢুকব ঠিক করেছি।
সে এক দিনকাল ছিল বটে, তখন বুক ফুলিয়ে টয়স্টোরি দেখতে ঢুকলেও কেউ ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকত না। তা শাহজাদা সঙ্গে ছিল, আর দশ কদম, সিনেমাও শুরু হব হব করছে, তো দিয়েছি ঘুরিয়ে। আর ঘুরিয়েই দেখি, মামা একটা স্কুটারের উপর গাধার উল্টোপিঠে, (গাধার আবার সোজা পিঠ হয় নাকি? কে জানে!) বসে লাঠি দোলাচ্ছেন। সেই যে সেই লোকটা একটা খালি বাথটাবে ছিপ দিয়ে বসে ছিল আর যেই কেউ ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘কি দাদা, কটা মাছ ধরলেন?’ তার উত্তরে বলছিল, ‘যাহ, খালি বাথটাবে মাছ থাকে নাকি! এ তো আপনার মতো বোকা ধরছি, আপনাকে নিয়ে খান সাতেক হল!’
তা মামাও লাঠি দোলাতে দোলাতে শর্টকাট পাবলিকদের ধরছে।
আমাকে ঘুরতে দেখেই ক্যাঁক করে আটকাতেই আমি হাঁউমাউ করে বলে উঠলাম, ‘ইয়ার আজ মত পাকড়ো!’সেও রসিক! জিজ্ঞাসা করে, ‘কিঁউ? আজ আপকা জনমদিন হ্যায় কেয়া?’
পাঠক/ পাঠিকা মনে করুন দিনটা ১৯শে নভেম্বর। আর ১৯শে নভেম্বর এসব সওয়াল কেউ করে! ফক করে প্যান কার্ড বার করে, (তখন আধার ফাদার দিনের আলো দেখেনি) ফিক করে হেসে বললাম, ‘একদম! ইয়ে দেখিয়ে!’
সে মামা দিলের ছিল, জাঠ হলেও সেন্স অব হিউমার, সর্ষের ক্ষেতে ফেলে আসেনি। তাই সেও ফুক করে হেসে বলল, ‘আচ্ছা যাইয়ে, হ্যাপ্পি বাড্ডে!’
তারপর এদিক ওদিক বেশ কিছুবার আলফালভাবে পুলিশ ধরেছে। একবার তো রবিবার দুপুরে ফ্লাইওভারের থেকে নামার সময় স্পিড ৬১ কিমি উঠে যাওয়ায় লাইসেন্স নিয়ে তিন মাস রেখে দিয়েছিল। তারপর লাইসেন্সের চচ্চড়ি করে ফেরত দিয়েছিল। তাও ২০ কিমি দূরে আরটিও থেকে এক দিনে বার দুই গিয়ে এনওসি নিয়ে এসে তবে।
তা তবে থেকে সেই চচ্চড়ি লাইসেন্সই প্যাকেটে ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে মোবাইলে গোটা লাইসেন্সের ছবি।
আর ইদানিং যে হেতু ক্যামেরায় ক্যাচ কট কট করছে তাই একদম নিয়ম ভাঙি না।
কিন্তু বিধি বাম হলে বিধানসভায় শূন্য হওয়া আটকায় কে!কাল একটা ইউটার্ন নিতে গিয়ে সামনের গাড়িটা ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলিয়ে দিল আর আমি ইউটার্ন না করে রাইট টার্ন নিতেই দেখি মামা দাঁড়িয়ে। একজন নয়, পুরো রাঙা মামা, ন’মামা আর সেজো মামা! কিসসু করনের নাই! দু হাত তুলে সারেন্ডার করলে স্টিয়ারিং কে ধরবে! তাই এক হাত তুলেই করলাম। রাঙা এসে সেজোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। সেজো বললে, ‘লাইছেন!’
আমি লাইসেন্সের ছবিটা আর চচ্চড়ি বার করলাম। বেশ কিছুদিন সে পার্সে থেকে আরও মজেছে আর স্বাদ যা হয়েছে না! তা সেজো দেখলাম ভালো। তাকে বললাম, ‘মামু সব দোষ আমার। মুহূর্তের সিদ্ধান্তহীনতা! আর কী করব! কপাল! ইত্যাদি এবং প্রভৃতি!’
তা সে আস্তে করে বলল, ‘স্যার নয়া বানওয়া লিজিয়ে। ওয়সে, রেড লাইট জাম্প করনে সে ৩ মাহিনে লাইসেন্স জব্দ হোতা হ্যায়! পর আপকা লাইসেন্স নিকালনে মে তো পাগলায় যায়েঙ্গে!’
এ সব ক্ষেত্রে না, ঠিক ‘পুশ ইন দ্য বুট’এর বেড়ালটার মতো জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিসসু বলতে নেই। আর আমি স্যার মামা দেখলেই গলে যাই!
আমার পনেরো দিনের না কামানো দাড়ি দেখে বোধহয় মায়া হল, বলল,’যাইয়ে!’
বাড়িতে গিয়ে পার্শ্ববর্তিনীকে বলতেই এমন মুখ করলেন যে কোদাল দিয়ে চেঁচে সাফ করে দিতে হল। আর সে যাক, গোটা লাইসেন্স না রাখার একটা সুফল অন্ততঃ পেলাম, কী বলেন! তবে আপনারা আবার লাইসেন্স দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধতে যাবেন না! কে বলতে পারে, ফোড়ন এদিক ওদিক হয়ে গেলে ক্যাটাভরাস কাণ্ড ঘটবে না!