(১৫৫)

বিশ্বাস করুন! আমি জানি রোববারের সকালে যদি কেউ কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে গল্প করতে আসে! বইমেলার ঘটনা টটনাও আমি চেপে রেখেছিলাম এদ্দিন ধরে! কিন্তু কাল গভীর রাতে যা ঘটল…
কাল পার্শ্ববর্তিনীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সুবোধ বড় গোপাল ছেলের মতো আমি ‘ডেডপুল’ দেখতে গেছিলাম। সিনেমা দেখে বেরিয়েছি! তখন রাত সাড়ে বারোটা। গাড়িটা নিয়ে একটা গোল চক্কর ঘুরতেই ‘ক্যাঁচ’ ‘হুড়মুড়’ ‘আহ আহ!’ আওয়াজ! গাড়ি পার্ক করে ছুটে গিয়ে দেখলাম আমার বেশ কিছু হাত দূরে একটি লোক পড়ে আছে ম্যাগির প্যাকেট, পিজ্জা, পেপসির বোতল আরও কিছুমিছু এদিক ওদিক ছড়ানো! আর তার সামনেই একটা বাইক একা দাঁড়িয়ে আর একটি লোক তাকে তোলার চেষ্টা করছে!

কে কাকে ধাক্কা মেরেছে? নাকি বাইক হড়কেছে? নাকি অন্য কিছু! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দৌড়ে গিয়ে সাহায্য করলাম। পেপসির বোতলটা গড়াগড়ি খেতে খেতে শক্ত হয়ে গেছে! পিজ্জাটা অটুট! ম্যাগিটা চানাচুরের মতো ছড়িয়ে গেছে! লোকটা উঠে দাঁড়াল! সঙ্গের লোকটি জিজ্ঞাসা করছে, আমিও জিজ্ঞাসা করছি! লোকটি বলল, পা ঠিক আছে, কিন্তু পশ্চাতে খুব ব্যথা! তারপর বাইকের দিকে তাকিয়ে বলল ব্যাকরেস্ট কিঁউ নেহী হ্যায়?
ততক্ষণে বিষয়টা অনুধাবন করেছি! সিনেমা দেখে ফেরা আরও কয়েকজন লোক এগিয়ে এসেছে! তারাও করেছে! এবারে উৎকণ্ঠার জায়গা নিল, ‘হো হো’ হাসি! আরে! একটা লোক পড়ে গেছে বা আহত হয়েছে আর আমরা হাসছি? কেসটা খুব করুণ মুখে বলতে গিয়ে সঙ্গী লোকটাও হেসে ফেলল! সঙ্গী লোকটি নীল রঙের বাজাজ অ্যাভেঞ্জার চালাচ্ছিল! কেতার বাইক! পিছনের ব্যাকরেস্টটা যে খোলা তা পিছনে বসে থাকা লোকটি খেয়াল করে নি! টার্ণিং-এর মুখে একটু আয়েস করে পিছনে ভার দিতে গিয়ে একদম চারপা তুলে দুম! আর হাতে সব জিনিসপত্র থাকায় ধরতেও পারে নিই কিছু!

আরে লোকের খোরাক! আহা আমারও যে এই অভিজ্ঞতা আছে তা আর বললাম না! সেই সেই ২০০২ সালের ১৯শে জানুয়ারি! তখনোও দু চাকা ঠিক করে চালাতে জানি না! তাই এক বন্ধুকে নিয়ে একটা নতুন স্কুটার কিনতে গেলাম! ১১৫ সিসি ১২৫ কিলোর ফোর স্ট্রোক বাজাজ লেজেণ্ড নেক্সট! তা তারপর সে বাড়ি অবধি পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল! মাংস ভাত রান্না করে তাকে খাওয়ালাম! তারপর তাকে টা টা করে স্কুটার নিয়ে ফিরবো! ক্লাচ ব্রেক এক্সিলেরটরের কারিকুরি তখনও ঠিক মত সড়গড় নয়! ব্যাস! ফার্স্ট গিয়ারে নিয়ে এক্সিলেরেটরে রেস দেবার আগেই দিয়েছি ক্লাচ ছেড়ে! ও মা স্কুটার পুরোপুরি ঊর্দ্ধগামী! আর আমি চার পা তুলে মাটিতে! নিজেই হাসছি বটে! কিন্তু পশ্চাৎদেশের বালিশ ফুঁড়ে একেবারে মর্মবিদির্ণ করে ধাক্কা লেগেছে! আইব্বাপ! কি ব্যথা হয়েছিল! দু মিনিট সোজা হাঁটতে পারছিলাম না! কিন্তু যাকে বলছি সেই কুটোপুটি হেসে! বোজো কাণ্ড!
যাই হোক! এখানেই শেষ করে দিতাম! কিন্তু তাহলে আপনারা আমায় ঠ্যাঙাতেন পাঠক/ পাঠিকারা! বইমেলা গেলাম এত সেলফি গ্রুপি আর পোজ! কই গল্প না করেই পালাব নাকি?

তাহলে বইমেলার গল্প হিসাবেই দিই কটা!

সৃষ্টিসুখ থেকে এবার সাড়া জাগানো বই বেরিয়েছে ‘মীর এই পর্যন্ত’ আর তা মিরাক্কেলের স্টেজ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে বিজ্ঞাপন করেছেন স্বয়ং মীর! ব্যাস! আর যায় কোথা! চাহিদার জোগান দিতে দিতে পেরে উঠছি না! এমন হল প্রথম সংস্করণ সব শেষ প্রথম তিনদিনেই! যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পূনর্মুদ্রণের খোঁজ পড়েছে! কিন্তু সময় তো লাগে! তাই মাঝে রবিবার আর সোমবার ‘মীর আছে?’ উত্তর দিচ্ছি ‘মঙ্গলবার পাবেন’ বলে!
এমন হল যে আমরা শিখে গেলাম কে মীরের বই খুঁজতে আসছে! তার মধ্যেই এক ব্যাক ফায়ার! মাটিতে বসে আছি! এক ভদ্রলোক এলেন! আমি জিজ্ঞাসা করলাম! “মীর?” “সে আবার কি? রাশিয়ান বই?” “না না আপনি দেখুন!” “আচ্ছা মীরের বই বললেন? সেটা কি অনুবাদ” “নাহ নাহ মীর আফসার আলির উপর বই বেরিয়েছে!” “সে কে?” “ওই যে মিরাক্কেল?” “অ”। নিষ্ক্রমণ! আমার ইগোর মহাপ্রস্থান!
বাদ বাকি চাহিদা না চাহিদা মিষ্টি খাওয়া আপ্যায়ন নতুন বন্ধু পুরনো বান্ধবী পেরিয়ে মনে থেকে গেল আরেক গল্প।

মানুষ সৌরাংশুকে ফেসবুক এবং অন্যান্য সূত্রে চেনেন অনেকেই! কিন্তু লেখক সৌরাংশুকে দেখে কেউ বাক্যহারা হয়ে বন্ধুকে চুপিচুপি বলছে যে ‘একসঙ্গে একটু সেলফি তুলব! তুই একটু বলবি!’ অনুরোধটা শুনে আমারই মুখ থেকে ইয়াব্বড় ‘অ্যাঁ’ বেরিয়ে গেছিল! যাই হোক! ছোট্ট ব্যাপার কিন্তু আমার লেখক সত্ত্বার কাছে তো ছোট নয়! মানে ফুটপাথজীবীর আর কি বা রোলসরয়েস! তাই মনেই থেকে যায়!
যেমন থেকে গেল, সেই গোলাপ পাতা পানের গল্প! ছেলেটি সদা হাস্যমুখে পানের মধ্যে আমসত্ত্ব, আঙুর, চকোলেট থেকে সব ধরণের খাদ্য সম্পদ দিয়ে রুপোলী তবকে মুড়ে তারপর খাদককে বলছে, ‘Open your mouth’ আর তারপর যে কোথায় সেই পান মিলিয়ে যাচ্ছে মুখে এক অকল্পনীয় স্বাদ রেখে…! রোহণ দেখে বলল, ‘যা সব দিচ্ছে তা দিয়ে জুতোর শুকতলা মুড়ে দিলেও দারুণ খেতে হবে!’
আর কিছু? সবই আছে! সব ভালোবাসা ছবি আদর ডিঙিয়ে কিছু কিছু ঘটনা মনের সদর দরজা দিয়ে ঢুকে চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকে সযত্নে! সেগুলো শুধু আমারই থাকুক না হয়! খালি স্টল ফেলে আসার স্মৃতি আবার তা ভরে দেবার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচি কটা মাস! আসছে বছর আবার হয়!

ও হ্যাঁ! ‘দেবাংশু সাহিত্য সম্মাননা’য় যারা উপস্থিত হলেন বা হতে পারলেন না! ফিসফাস লেখকের পক্ষ থেকে একটা ধন্যবাদ না দিলে তো চলেই না! বেশ সুন্দর কাটল সন্ধ্যাটা!

ইম্প্রোভাইজও করতে হল কয়েকবার! যেমন আগের অনুষ্ঠানটি ছিল সেক্সপিয়ার সোসাইটির! তারা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে! সাতটা পনেরো পেরিয়ে গেছে! আর আমি একটু একটু করে স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি মিডিয়া সেন্টারে! যিনি আয়োজক তিনি বিব্রত! কিন্তু বিদগ্ধ জন্মেদের কবিতা পাঠ আর বক্তৃতা তাও চলেছে সমানে! আরে যেন আর কোথাও কেউ কবিতা পড়তে দেবে না!

তারপর সেই নিচু মাইকে বলতে বলতে তা হাতে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করা! বাবা এবং আমার দুই পিসতুতো দাদার হাত দিয়ে সিদ্ধার্থদাকে প্রথম দেবাংশু সাহিত্য সম্মাননা প্রদান! দুদিন পরে বিয়ে বাড়ি যাবার জন্য ট্যাক্সির জন্য ছোটাছুটি! সিঁথির মোড়ের প্রেস থেকে বই নিয়ে আসা! আর বন্ধুদের সান্নিধ্য! এই সব টুকরো স্মৃতি জড়িয়েই তো বইমেলা! আবার আসব বললেই তো আর অঙ্গীকার আর মনের ভালোলাগা বোঝানো যায় না! কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়! পাঠক পাঠিকারা, এতদিনের সম্পর্ক! নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি! সব কথা না হয় নাই লিখলাম! সঙ্গে থাকবেন! আরও গল্প হবে! আজীবন! আমেন!

3 thoughts on “(১৫৫)

    • বইটা কত ভালো তার থেকেও বড় কথা মীরের গ্রাম বাংলা এবং শহরতলি এবং শহরের নিম্নমধ্যবিত্তে এতটা ফ্যান ফলোয়িং! না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না!

      Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান